শেষপর্যন্ত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাবায়নে একমত হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আইএমএফের হিসাবে বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ২৭.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আইএমএফের প্রতিনিধি দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে রিজার্ভ ইস্যুটি খুবই স্পর্শকাতর, এ কারণে আইএমএফের পদ্ধতিতে রিজার্ভ গণনা শুরু হতে একটু সময় লাগবে। আইএমএফের পদ্ধতি অনুসরণ করলে দেশে রিজার্ভ ৩৫ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে দাঁড়াবে ২৭.৪ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ আইএমএফের হিসাবে রিজার্ভ থেকে ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কমবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আইএমএফের সফররত মিশনের বৃহস্পতিবার (২৭ অক্টোবর) অনুষ্ঠিত বৈঠকে এমন সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। মিশনের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধি দল আগামী ৯ নভেম্বর পর্যন্ত অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করবে। বাংলাদেশ সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ চাওয়ার পর আনুষ্ঠানিক আলোচনার জন্য এ মিশন ঢাকায় এসেছে।
বৈঠকে প্রতিনিধি দলকে জানানো হয়, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হিসাব প্রকাশের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা করে কবে নাগাদ শুরু করা হবে, তা সিদ্ধান্ত হবে। আইএমএফের পদ্ধতি অনুসরণের পাশাপাশি শুরুতে বিদ্যমান পদ্ধতির হিসাবও প্রকাশ করা হবে।
দীর্ঘদিন ধরে আইএমএফ’র পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রিজার্ভ থেকে অর্থ নিয়ে আলাদাভাবে বিভিন্ন তহবিল গঠন ও সেখান থেকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। আবার ওইসব অর্থ রিজার্ভে দেখানো হচ্ছে। এতে রিজার্ভ বেশি দেখানো হচ্ছে। যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। এভাবে রিজার্ভের হিসাব দেখানো ঠিক হচ্ছে না। আইএমএফ মনে করে এতে দেশের প্রকৃত রিজার্ভের চিত্র ফুটে উঠছে না। রিজার্ভের প্রকৃত চিত্র আড়াল করায় বাংলাদেশেরই বরং ঝুঁকি বাড়ছে। আইএমএফের দৃষ্টিতে এই গরমিলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশের স্বার্থেই এ হিসাব আন্তর্জাতিকমান অনুযায়ী করা উচিত। তারা আরও বলেছেন-ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ আইএমএফ’র সদস্য সব দেশই আইএমএফ’র প্রচলিত আন্তর্জাতিকমান মেনে রিজার্ভের হিসাব করে এবং তা প্রকাশ করে। কিন্তু বাংলাদেশ রিজার্ভের হিসাবের ক্ষেত্রে আইএমএফ’র মান মানছে না। নিজেদের মতো করে হিসাব করে বেশি রিজার্ভ দেখাচ্ছে। আইএমএফ বাংলাদেশ ব্যাংকে নিট হিসাবে বিভিন্ন তহবিলের অর্থ বাদ দিয়ে হিসাব দেখাতে বলছে। যদিও গ্রস হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকা সব বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে দেখানো হচ্ছে।
আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ৬ সেশনের বৈঠকের প্রথম পর্বে দুপুর ২টা পর্যন্ত তিনটি সেশন হয়। প্রথম পর্বের বৈঠকে বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণসহ আর্থিক খাতের সংস্কার, নীতি ও ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা নিয়ে আলোচনা হয়। বিকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ এবং অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের সঙ্গে বৈঠকে বসে প্রতিনিধি দল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে প্রথম বৈঠকে আইএমএফ’র মিশন প্রধান রাহুল আনন্দ নেতৃত্ব দেন। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল, কাজী ছাইদুর রহমান, সাজেদুর রহমান খান ও প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া আইএমএফ মিশনের সদস্যরাও ছিলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি তুলেছে। তারা রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক রীতি অনুসরণ করতে বলেছে। এছাড়া ডলারের একাধিক দর নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। আইএমএফ মনে করে এতে আন্তর্জাতিক মহলে বিভ্রান্তি দেখা দিচ্ছে। তারা ডলারের দরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছে। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন পদ্ধতিকে আরও স্বচ্ছ ও নিরাপদ করার কথা বলেছে।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘বৈঠকে রিজার্ভ নিয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে। এ নিয়ে যার যার অবস্থান থেকে যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তাদেরকে বলা হয়েছে, রিজার্ভের হিসাব বাংলাদেশ দুভাবে করছে। গ্রস ও নিট হিসাব। গ্রস হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকা সব বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে দেখানো হচ্ছে। নিট হিসাবে বিভিন্ন তহবিলের অর্থ বাদ দেওয়া হচ্ছে।’
জানা গেছে, রফতানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) সরবরাহ করা সাত বিলিয়ন ও শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া ২০ কোটি ডলার রিজার্ভে দেখাচ্ছে। এছাড়া গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ) ২০ কোটি, লং টার্ম ফিন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি (এলটিএফএফ) তহবিলে ৩ কোটি ৮৫ লাখ, সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমানকে ৪ কোটি ৮০ লাখ এবং ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইটিএফসি) আমানত রিজার্ভে দেখাচ্ছে। সবমিলিয়ে বর্তমানে রিজার্ভে যে অর্থ দেখানো হচ্ছে, সেখান থেকে ৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার বা ৮৪০ কোটি মার্কিন ডলার বাদ যাবে বলে মনে করে আইএমএফ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, রিজার্ভের বিষয়ে যে বিতর্ক তা আংশিক সত্য। আইএমএফ চায় ৮০০ কোটি ডলারের তহবিল রিজার্ভ থেকে বাদ দিতে। বৈঠকে উপস্থিত থাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক কর্মকর্তা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে তাদেরকে জানানো হয়েছে, আমরা নীতিগতভাবে আইএমএফের সঙ্গে একমত। আগামীতে আন্তর্জাতিক হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ করেই রিজার্ভ হিসাবায়ন করব। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক এখন যে পদ্ধতিতে হিসাব করে সেটাও প্রকাশ করবে। বর্তমানে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ ৩৫ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার। তবে আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ করলে তা কমে দাঁড়াবে ২৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার।
বৈঠকে আইএমএফ ডলারের একাধিক দর নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে দলটি ডলারের একটি ইউনিক দরে রাখার পরামর্শ দিয়েছে। এছাড়াও ঋণ ও আমানতে সুদহারে আরোপিত সীমাও প্রত্যাহার চায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল। বর্তমানে ঋণে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ এবং ব্যক্তি পর্যায়ের মেয়াদি আমানতে গড় মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশি সুদ দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে উঠলেও সুদহারে সীমা তুলে দেওয়ার বিষয়ে অর্থনীতিবিদ অনেকেই পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন।মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সুদহার বাজারভিত্তিক হওয়া উচিত।
আইএমএফ বলছে, ঋণের সুদহার এতো কম রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে। চাহিদা ব্যবস্থাপনার জন্য সুদহার বাড়ানো প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুদহারকে একটি লক্ষ্যভিত্তিক করার কথা বলেছে আইএমএফ। এ ছাড়া আগামীতে প্রতিবছর চারবার মুদ্রানীতি প্রকাশের লক্ষ্যে আপাতত বছরে দুইবার ঘোষণা করতে বলা হয়েছে। এর আগে বছরে দুইবার মুদ্রানীতির ভঙ্গি ঘোষণা করতো বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু সাবেক গভর্নর ফজলে কবির দায়িত্ব নেওয়ার পর বছরে একবার মুদ্রানীতি ঘোষণা শুরু করেন।
চলতি বছরের ২২ মে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল, শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া ঋণসহ কয়েকটি বিষয় বাদ দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাবায়নে আইএমএফের পরামর্শ মানবে না বাংলাদেশ ব্যাংক। সংস্থাটির হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ করলে দেশের রিজার্ভ প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার কমবে। বর্তমান অবস্থায় তাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নামবে ৩৪ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। সংস্থাটির হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ না করে বিদ্যমান নিয়মেই হিসাব চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
গত বছরের ৩ থেকে ১৪ অক্টোবর আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসে। বাংলাদেশ সফরের পর সংস্থাটির পক্ষ থেকে একটি ‘সেফগার্ড অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট’ বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়। সেখানে রিজার্ভ হিসাবায়নে বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তারতম্য উল্লেখ করে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে তা নিরসন করার সুপারিশ করা হয়। এরপর গত বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সংস্থাটিকে চিঠি দিয়ে প্রাথমিকভাবে রিজার্ভের হিসাবায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন না আনার সিদ্ধান্ত জানানো হয়।