মে দিবস এসে চলে যায়। কিন্তু উপেক্ষিত থেকে যায় কৃষি শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দাবি। অথচ কৃষিভিত্তিক এই দেশের মোট জনশক্তির প্রায় ৫০ ভাগ এখনও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কৃষিকাজে নিয়োজিত। কিন্তু কৃষি শ্রমিকদের নেই কোনো সংগঠন, সমিতি বা কারখানার শ্রমিকদের মতো ট্রেড ইউনিয়ন। তাই মৌলিক ও সামাজিক অধিকার, সুযোগ-সুবিধার দাবি থেকে যাচ্ছে আড়ালে।
দেশে সংখ্যাগরিষ্ট শ্রমিক এখনও কৃষি কাজে নিয়োজিত। খাদ্য নিরাপত্তার অনেকাংশই যাদের উপর নির্ভর করে একবিংশ শতাব্দীতে এসে উন্নয়নশীল বাংলাদেশে তারাই রয়ে গেছেন শ্রমনীতির বাইরে। শ্রমঘণ্টার শিকলে আবদ্ধ না থাকা এ সকল শ্রমিকরা তাই আজীবনই বঞ্চিত থাকছেন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুরক্ষা সুচক থেকে।
তাহিরপুরে শনির হাওরে ধানকাটায় ব্যস্ত শ্রমিকরা। তারই একজন ৬০ উর্ধ্ব রওশন আলী। পরনের পোশাকে বেশ কয়েকে জায়গায় সেলাই দেওয়া। চেহারায় ফুটে উঠে দারিদ্রতার স্পষ্ট চাপ। রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে ধান কাটা থেকে শুরু করে কাঁচা ধানের বোঝা মাথায় নিয়ে মাইলের পর মাইল হেটে গৃহস্তের উঠান পর্যন্ত পৌছে দিতে হয় তাকে। এভাবে ৪০ বছর ধরে প্রতি বৈশাখেই হাওরে শ্রম দেন তিনি। ধান কাটতে কাটতে কালো দাড়ি-সাদা হয়েছে তার কিন্তু ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি।
রওশন আলী বলেন, ‘প্রচুর কষ্ট হয়। কষ্টের কোনো শেষ নেই। এই যে রোদ যাচ্ছে এগুলো সব আমাদের ওপর দিয়েই যায়।’
বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে ঝড়-বৃষ্টির দাপট, সঙ্গে হঠাৎ বজ্রপাতে জীবনের ঝুঁকিও। এসবের মধ্যে প্রতিদিন রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হাওরাঞ্চলে কাজ করেন অন্তত ৮ লাখ শ্রমিক। তারাও রওশন আলীর মতো শ্রমের প্রকৃত মজুরি থেকে বঞ্চিত। দিন শেষে যা পান সেই আয়ে সংসারে টানা-পোড়েন শেষ হয় না।
একজন শ্রমিক বলেন, ‘আমরা মাত্র ৬০০ টাকা পাই। এই সময়ে এ টাকা দিয়ে কি চলা যায়? ৬০০ টাকায় সংসার চলে না। জিনিসপত্র সবকিছুর দাম বেশি।’
মাঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কেটে রাখা সোনালি রঙের ধান। পুরুষের পাশাপাশি নারী শ্রমিকেরা কাজ করছেন সেখানে। হাওরাঞ্চলে মোট শ্রমিকের এক তৃতীয়াংশ নারী শ্রমিক। তারা ধান মাড়াই, শুকানো, সংগ্রহ সহ অনেক কাজ পুরুষের চেয়ে বেশী করলেও মজুরী পান অনেক কম।
একজন নারী শ্রমিক বলেন, ‘সারাদিন কাজ করলে আমাদের ৪০০ টাকা দেয়। আমাদের খুব কষ্ট হয়ে যায়। পুরুষরা তো ৬০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্তও পেয়ে থাকে।’
শ্রম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্যে নিরবচ্ছিন্ন স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ও দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষি শ্রমিক তথা কৃষকদের ক্ষমতায়নের কোনো বিকল্প নেই।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিকৃবি) কৃষি অর্থসংস্থান ও ব্যাংকিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শাহ আলমগীর বলেন, ‘ধান উৎপাদন খরচ কমিয়ে, ধানের দাম বাড়িয়ে কৃষকরা লাভবান হবে না। বাজার ব্যবস্থাপনায় আমাদের কৃষকদের সে সামর্থ্য নেই যে তারা বাজার থেকে সরকার নির্ধারিত দামে ধান বিক্রি করতে পারবে। কারণ এখানে কিছু মধ্যস্থতাকারী কাজ করে।’
সিকৃবির কৃষি অর্থনীতি ও পলিসি বিভাগের অধ্যাপক ড. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘প্রণোদনা প্যাকেজ তাদের জন্য নেওয়াটা জরুরি। বা ওই সময় যদি অন্য কোনো কাজে তাদেরকে না দেওয়া যায়, তাদেরকে বেকার ভাতার মতো শ্রমিক ভাতা দিয়ে হলেও কৃষি কাজে নিয়োজিত রাখতে হবে।’
কৃষিবীদদের মতে কৃষক ও কৃষি শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার নিয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
সিকৃবির উপাচার্য অধ্যাপক মো. জামাল উদ্দিন ভুঞা বলেন, ‘শুধু ধান কাটা বা ধান লাগানো, নিরানো না। এবং কৃষি যন্ত্র চালানোর জন্যও তাদের দক্ষতা অর্জন প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের মাধ্যমে কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।’
কৃষি নির্ভর অর্থনীতির দেশে কৃষিকে যেমন উপেক্ষা করা যায় না তেমনি এ খাতে নিয়োজিত শ্রমিক, বিশেষত মজুরী ভিত্তিক শ্রমিকের অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। দেশের সমষ্টিগত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য হলেও কৃষি শ্রমিকের সার্বিক উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই।