বৃত্তান্ত প্রতিবেদক: বাম্পার ফলন ও বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির কারণে দেশে পেঁয়াজের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ খাদ্যপণ্যটি নিয়ে যাতে কারসাজি না হয়, সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে আগেভাগে উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি করা হচ্ছে, যেন দাম সহনীয় থাকে। এজন্য টিসিবির পক্ষ থেকে পণ্যটির ব্যাপক মজুতও গড়ে তোলা হয়েছে।
এরপরও গত দুবছরের মতো এ বছরও পণ্যটি নিয়ে অসাধু কিছু ব্যবসায়ী কারসাজি শুরু করেছে। দাম তারা বাড়িয়েই চলেছে। রাজধানীর খুচরা বাজারে মাসের ব্যবধানে কেজিতে ২৫ টাকা বেড়ে পণ্যটি সর্বোচ্চ ৭০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। চট্টগ্রামেও এক মাসে কয়েক দফা দাম বেড়ে কেজি সর্বোচ্চ ৭০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
এ কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যটি কিনতে ভোক্তাদের বাড়তি ব্যয় ও পকেট খালি করতে হচ্ছে।
টিসিবির মঙ্গলবারের বাজারমূল্য তালিকায় যায়, মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৪৯.৫৩ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২৯.৪১ শতাংশ বেশি দরে।
এছাড়া রাজধানীর কাওরান বাজার, নয়াবাজার ও মালিবাগ কাঁচাবাজার ঘুরে ও খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৬৫-৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে; যা মাসখানেক আগে বিক্রি হয়েছে ৪২-৪৫ টাকা। সেক্ষেত্রে মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ সর্বোচ্চ ২৫ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকা। যা এক মাস আগে ৪০-৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
রাজধানীর সর্ববৃহৎ পাইকারি আড়ত শ্যামবাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মঙ্গলবার প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ পাইকারি বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকা যা এক মাস আগে ৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি প্রতি কেজি আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৫৫ টাকা। যা এক মাস আগেও ২৫-২৭ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
রাজধানীর মালিবাগ বাজারের খুচরা পেঁয়াজ বিক্রেতা আবু সালেহ এই প্রতিবেদককে বলেন, পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। সেখান থেকে বেশি দরে পেঁয়াজ কিনে আনতে হচ্ছে। তাই বেশি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে দাম বেশি কেন সে বিষয়ে পাইকাররা কিছু বলতে পারেননি।
পাইকারি বাজারে দাম বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে শ্যামবাজারের পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সংকর চন্দ্র ঘোষ বলেন, এ সময়টাতে প্রতি বছর পেঁয়াজের কিছুটা দাম বাড়ে। দেশে পেঁয়াজের মৌসুম শেষ। নতুন পেঁয়াজ দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে বাজারে আসবে। সে কারণে বাজারে একটু অল্প পেঁয়াজ আছে। তবে যে পেঁয়াজ আছে তাতে দাম বাড়ার কথা নয়। আমদানিকারক ও বড় মোকাম মালিকরা পণ্যটির দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। যে কারণে পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে।
তিনি জানান, এবার পণ্যটির যাতে দাম না বাড়ে সে জন্য টিসিবির পক্ষ থেকে আগেভাগে প্রস্তুতি রাখা হয়েছে। আমদানির মাধ্যমে ব্যাপক মজুতও গড়ে তোলা হয়েছে। বাজার স্বাভাবিক রাখতে ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি শুরু হয়েছে। তারপরও দাম বাড়ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এবার দেশে পেঁয়াজের বাম্পার ফলন হয়েছে। যা গত কয়েক অর্থবছরের চাইতেও বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদন বেড়ে পেঁয়াজের ফলন হয়েছে ৩৩.৬২ লাখ টন।
এরআগে ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে পেঁয়াজের ফলন হয়েছে ১৯.৩০ লাখ টন। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ফলন হয়েছে ২১.৩০ লাখ টন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ফলন হয়েছে ২৩.৫৩ লাখ টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ফলন হয়েছে ২৩.৩০ লাখ টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ফলন হয়েছে ২৩.৩০ লাখ টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বেড়ে ফলন হয়েছে ২৫.৬০ লাখ টন।
অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২৫ লাখ টন। সাধারণত স্থানীয়ভাবে উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে পেঁয়াজের চাহিদা পূরণ করা হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে যে পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে এবং যে পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে-তাতে পেঁয়াজের সংকট হওয়ার কথা নয়। দাম বাড়ারও কথা নয়।
দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ও ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমানের মতে, গত দুই বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে পেঁয়াজ নিয়ে অসাধুরা কারসাজি করেছে। তাদের কোনোভাবে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। যে কারণে তারা কোন সুযোগ পেলেই ভোক্তার পকেট কাটছে।
টিসিবি সূত্র জানায়, পেঁয়াজের দাম যেন না বাড়ে সেজন্য আগেভাগেই প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। মজুত গড়ে তোলা হচ্ছে। টিসিবি প্রতি কেজি পেঁয়াজ ভর্তুকি মূল্যে ৩০ টাকা বিক্রি করছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, কেন পণ্যটির দাম বাড়ছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম পেলে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে।
জানা যায়, দেশের অন্যতম বৃহৎ ভোগ্যপণ্যের বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে একদিনের ব্যবধানে মঙ্গলবার প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৬ টাকা বেড়ে ৫৫-৫৭ টাকা বিক্রি হয়েছে। আর খুচরা বাজারে বিক্রি হয়েছে ৬৫-৭০ টাকায়। অথচ এক সপ্তাহ আগেও খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা।
বাজার ঘুরে দেখা যায় পেঁয়াজের সংকট নেই। তবে বাজার অস্থির হয়ে ওঠায় খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে মজুতের প্রতিযোগিতা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ কিনতে ছুটে আসছেন খাতুনগঞ্জে। তাই চাহিদা বেড়েছে। ট্রাক থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই পেঁয়াজ শেষ হয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় পেঁয়াজের সরবরাহ কিছুটা কমলেও সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে মিয়ানমারের পেঁয়াজ। গত দুদিনে টেকনাফ হয়ে মিয়ানমারের বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন আড়তে এসেছে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অন্য বছর ভারত রফতানি বন্ধ করে দেওয়ার পর বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। কিন্তু এবার রপ্তানি স্বাভাবিক থাকা অবস্থায়ই দাম বাড়তে শুরু করেছে। আমদানিকারক ও আড়তদারদের বড় একটি সিন্ডিকেটের কারসাজিতে পেঁয়াজের বাজার ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী। এক সপ্তাহ আগের কেনা পেঁয়াজও বাড়তি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ।
ভারতীয় পেঁয়াজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশি ও মিয়ানমারের পেঁয়াজের দামও বাড়ানো হয়েছে। যার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।
খাতুনগঞ্জ হামিদ উল্যাহ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস বলেন, আমদানিকারকরা বেনাপোলসহ বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আনে। আমরা শুধু কমিশনের ভিত্তিতে বিক্রি করি। দাম ঠিক করে দেয় আমদানিকারকরা। দাম বাড়া-কমার পেছনে আমাদের হাত নেই।
এ ব্যবসায়ী আরও জানান, দাম বাড়ার খবরে গত কয়েক দিন ধরে কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা খাতুনগঞ্জে ভিড় করছেন। তাই চাহিদা বেড়ে গেছে। মিয়ানমারের পেঁয়াজ দিয়ে বাড়তি চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। সোমবার মিয়ানমারের পেঁয়াজ নিয়ে ২০-৩০ ট্রাক এবং ভারতীয় পেঁয়াজ নিয়ে ১০-১২ ট্রাক খাতুনগঞ্জে প্রবেশ করেছে।