প্রবাসীদের অনেকেই দেশে থাকা স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে মোবাইল ফোনের অ্যাপ ‘ইমো’ ব্যবহার করেন। তাদের একটি বড় অংশ প্রযুক্তি বিষয়ে ততটা ওয়াকিবহাল নন। এমন ব্যক্তিদেরই খুঁজে বের করে চক্রের সদস্যরা। এরপর তার নম্বরে ফোন করে সখ্য গড়ে তোলার চেষ্টা চালায়। কখনও ইমো নম্বরে মেসেজ পাঠিয়ে তাদের অ্যাকাউন্টে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করে। পরে সমাধানের পথ বাতলে দেওয়ার নামে প্রয়োজনীয় নানা তথ্য জেনে নেয়। বিশেষ করে তাদের ফোনে ওটিপি বা ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড পাঠানোর ব্যবস্থা করে। কোনো অজুহাতে সেই ওটিপি জেনে নেয় এবং সেটি কাজে লাগিয়ে ইমো অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে। পরে ওই অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে তার আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, অনলাইনে প্রতারণার নতুন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে ইমো। সহজ-সরল মানুষকে বোকা বানিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। প্রচুর তরুণ-যুবক এতে জড়িয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে প্রকৌশলী যেমন আছে, তেমনি সাধারণ মুদি দোকানিও আছে। আর ইমো হ্যাকারদের আখড়া বা হেড অফিস হয়ে উঠেছে নাটোরের লালপুর। এই চক্রের অর্ধশতাধিক সদস্যের অবস্থান পাওয়া গেছে ওই এলাকায়। এর মধ্যে অন্তত ২০ জনকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও র্যাব।
ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার জুনায়েদ আলম সরকার সমকালকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষের উপস্থিতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতারকরাও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। মানুষকে নানাভাবে ফাঁদে ফেলে বা ভুল বুঝিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। এ ধরনের প্রতারকের বিরুদ্ধে আমরা সতর্ক অবস্থানে আছি। সন্দেহজনক তৎপরতা বা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ গত ২৪ আগস্ট পলাশ আলী ও সাব্বির হোসেন নামের দু’জনকে নাটোরের লালপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তদন্ত সংশ্নিষ্টরা জানান, পলাশ বস্ত্র প্রকৌশল বিষয়ে পড়ালেখা করে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। আর সাব্বির এইচএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। তারা ২০১৮ সাল থেকে ইমো হ্যাক করে অর্থ আদায় শুরু করেন। সাব্বির প্রবাসী বাংলাদেশিদের মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করে তা পলাশকে দিতেন। প্রযুক্তি বিষয়ে ভালো জ্ঞান রাখা পলাশ ওইসব নম্বরে ওটিপি পাঠানোর পর তাদের ফোন করতেন। এটা-সেটা বলে ওটিপি জেনে তাদের ইমো অ্যাকাউন্টের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রতারণা শুরু করতেন।
এক কর্মকর্তা জানান, সাধারণত ওই অ্যাকাউন্টধারীর আত্মীয়স্বজনের কাছে কল করে বা মেসেজ পাঠিয়ে বিপদে থাকার কথা বলে টাকা ধার চায় প্রতারকরা। অনেক সময় তারা গলা পাল্টে বা বিশেষ অ্যাপ/সফটওয়্যার ব্যবহার করে কথা বলায় স্বজনরাও প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারেন না। তারা বিপদের কথা শুনে দ্রুত বিভিন্ন অঙ্কের টাকা দিয়ে দিতেন। পরে যখন তারা প্রকৃত ঘটনা জানতে পারতেন, তখন আর কিছু করার থাকত না।
এ ছাড়া মাঝেমধ্যেই ইমো হ্যাক চক্রের সদস্যরা ধরা পড়ছে ডিবিসহ পুলিশের অন্যান্য ইউনিটের অভিযানে। তাদের প্রায় সবাই নাটোর বা আশপাশের এলাকার। ২৯ আগস্ট রাজশাহীর বাঘা থেকে আরব আলী নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে স্থানীয় পুলিশ। সে ওই অঞ্চলের ইমো হ্যাক চক্রের হোতা ছিল বলে জানানো হয়। দীর্ঘদিন ধরে সে প্রবাসীদের ইমো হ্যাক করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ আদায় করে আসছিল। স্থানীয় মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের সঙ্গে বিশেষ বৈঠকের পর তাকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়।
এর আগে মে মাসের শেষ সপ্তাহে নাটোরের লালপুর থেকে ইমো হ্যাক চক্রের ১৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে রথ্যাব-৫। লালপুরের মোহরকয়া গ্রামে ওই অভিযান চালানো হয়। তখন প্রতারণায় ব্যবহূত ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। র্যাব জানায়, প্রথমে পাপ্পু আলী, আজিম উদ্দিন, অন্তর আলী, স্বাধীন ও সজীব আলীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ভাঙ্গাপাড়া গ্রাম থেকে ফরিদ, রবিউল ইসলাম, মোহন, শাহপরান, আশিকুর, মাহিন, শাহাবুল, রুবেল, আলম, সিরাজুল ইসলাম ও নাজিম আলীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তারা দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের ইমো অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে তাদের স্বজনের কাছ থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার কথা স্বীকার করেছে।
পুলিশ-র্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, মোবাইল ফোনে কোনো ওটিপি বা কোড এলে তা কাউকে জানানো থেকে বিরত থাকুন। আত্মীয়স্বজন পরিচয়ে কেউ টাকা চাইলে যাচাই না করে দেবেন না। আর আপনার ইমো অ্যাকাউন্ট অন্য কারও দখলে আছে কিনা জানতে ‘অ্যাকাউন্ট অ্যান্ড সিকিউরিটি’ অপশনে ঢুকে ম্যানেজ ডিভাইসে ক্লিক করুন।
সমকাল থেকে