ভেন্টিলেশন থেকে ফিরতে পারলেন না। কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন তরুণ মজুমদার। বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। কিডনি এবং হৃদ্যন্ত্রের সমস্যায় দীর্ঘ দিন ধরেই ভুগছিলেন প্রবীণ চলচ্চিত্র পরিচালক। গত ১৪ জুন তাঁকে ভর্তি করানো হয় হাসপাতালে। অবস্থার অবনতি হওয়ায় কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁকে উডবার্ন ওয়ার্ড থেকে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়। পরে সেখানে অবস্থার কিছুটা উন্নতিও হয়েছিল তাঁর। কিন্তু সম্প্রতি আবার অবনতি হতে থাকে তাঁর শারীরিক অবস্থার। রবিবার তাঁকে আবার ভেন্টিলেশনে দিতে হয়। সেখান থেকে আর তাঁকে ফেরাতে পারেননি চিকিৎসকরা। সোমবার সকাল ১১টা ১৭ মিনিটে মৃত্যু হয় প্রবীণ পরিচালকের।
গত ১৪ জুন কিডনির সমস্যা সহ একাধিক অসুস্থতা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তরুণ মজুমদার। গত ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। পাশাপাশি ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যাও ছিল তাঁর।
মাঝে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছিল পরিচালকের। কিন্তু সে অবস্থা বেশিদিন থাকেনি। আবারো অসুস্থ হয়ে পড়াতে উডবার্ন ওয়ার্ড থেকে তাঁকে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটে। রবিবার ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছিল। সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন পরিচালক।
বাংলা চলচ্চিত্র জগতের দিকপাল পরিচালকদের মধ্যে একজন তরুণ মজুমদার। শচীন মুখোপাধ্যায় এবং দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলে ‘যাত্রিক’ দল গঠন করেছিলেন তিনি। দলের প্রথম পরিচালিত ছবি ছিল চাওয়া পাওয়া। ওই দলের ‘কাঁচের স্বর্গ’ ছবি পেয়েছিল জাতীয় পুরস্কার।
তরুণের পরিচালিত যে সমস্ত ছবি সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম— পলাতক (১৯৬৩), নিমন্ত্রণ (১৯৭১), সংসার সীমান্তে (১৯৭৫) এবং গণদেবতা (১৯৭৮)। তাঁর পরিচালিত হিট ছবিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য— বালিকা বধূ, কুহেলি, শ্রীমান পৃথ্বীরাজ, ফুলেশ্বরী, দাদার কীর্তি, ভালবাসা ভালবাসা, আপন আমার আপন-এর মতো সিনেমা গুলি।
১৯৬২ সালে ‘কাচের স্বর্গ’ ছবির জন্য প্রথম জাতীয় পুরস্কার পান পরিচালক। মোট চারটি জাতীয় পুরস্কার জয়ী চলচ্চিত্র পরিচালককে কেন্দ্র পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে ১৯৯০ সালে। এ ছাড়াও, বিএফজেএ পুরস্কার এবং আনন্দলোক পুরস্কারেও সম্মানিত করা হয়েছিল পরিচালককে।
১৯৩১ সালের ৮ জানুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলার বগুড়ায় জন্ম তরুণের। বাবা বীরেন্দ্রনাথ মজুমদার ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। তরুণের পড়াশোনা কলকাতাতেই। সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রাল মিশন কলেজ এবং স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্র তরুণ পরে রসায়ন নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তরুণের ফিল্ম জগতে পদার্পণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করার পরই। তবে ১৯৫৯ সালে প্রথম ফিল্ম পরিচালনায় আসেন তিনি। উত্তম কুমার সুচিত্রা অভিনীত ‘চাওয়া পাওয়া’ ছবিটি দিয়ে। তখন তাঁর বয়স ২৮।
বর্ষীয়ান অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায়ের জীবনে তরুণ মজুমদার একাধারে স্বামী, পরিচালক, গুরুর ভূমিকা পালন করেছেন। এক সঙ্গে কাজ করতে করতে প্রেম। সেই প্রেম আরও গাঢ় সাতপাকের বাঁধনে। পরিচালক-নায়িকার প্রেম-পরিণয় নতুন নয়। তবে তনুবাবু-সন্ধ্যায় রায়ের প্রেম বহু ভাল ছবি, নতুন নায়ক-নায়িকার জন্ম দিয়েছে। মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়, রাখী গুলজার, তাপস পাল, অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়, মহুয়া রায়চৌধুরী, দেবশ্রী রায়, নয়না বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ তরুণ মজুমদারের আবিষ্কার। ‘ফার্স্ট লুক’ থেকেই প্রত্যেক নায়িকাকে যত্ন নিয়ে তৈরি করতেন সন্ধ্যা নিজে। অভিনয়ের প্রশিক্ষণও দিতেন দু’জনে। যার ফলাফল একমুঠো জনপ্রিয় ছবি।
সে সব স্মৃতিতে আবারও আচ্ছন্ন বর্ষীয়ান অভিনেত্রী। ধরা গলায় দাবি, ‘‘কী অসম্ভব প্রাণপ্রাচুর্য ছিল। কী অসম্ভব কাজপাগল ছিলেন। অনেক দিন সে ভাবে যোগাযোগ নেই। কিন্তু তাঁর সব খবরাখবরই পেতাম। বড্ড শখ ছিল, শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জনপদবধূ’ উপন্যাস নিয়ে ছবি বানাবেন। নায়িকা হিসেবে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ওঁর প্রথম পছন্দ ছিলেন। পাশাপাশি, ছবিতে নাচের ভূমিকাও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ছবিটা আর করা হয়ে উঠল না।’’
দীর্ঘ দিনের অদর্শন। তবু প্রবীণ অভিনেত্রী ভুলতে পারেন না, ষাট-সত্তরের দশক ছিল তরুণ মজুমদার-সন্ধ্যা রায় জুটির।
সাল ১৯৬৫। ‘একটুকু বাসা’ এবং ‘আলোর পিপাসা’ ছবি দু’টি বানিয়েছিলেন তরুণ মজুমদার। যথাক্রমে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং বসন্ত চৌধুরী নায়ক। দু’টি ছবিতেই নায়িকা সন্ধ্যা রায়। এই জুটির জনপ্রিয় ছবি ‘ঠগিনী’, ‘ফুলেশ্বরী’, ‘পলাতক’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘কুহেলি’, ‘সংসার সীমান্তে’। এ ছাড়া, ‘বালিকা বধূ’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-সহ তরুণবাবুর প্রায় সমস্ত ছবিতেই সন্ধ্যা রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয় করেছেন।