পুরান ঢাকায় বাড়ি রফিকুল ইসলামের। পেশা মেশিনারিজের দোকানের কর্মচারী। ১০ বছর ধরে ধীরে ধীরে ৫ লাখ টাকা জমান। সেই টাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নির্মাণাধীন বহুতল একটি বিপণিবিতানে দোকান বুকিং দিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে তাঁর দোকান বুঝে পাওয়ার কথা ছিল। এরপর বছর গড়িয়েছে। কিন্তু দোকান বুঝে পাননি তিনি। কবে পাবেন, সেটাও জানেন না। ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষও এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে কিছু বলছে না।
শুধু রফিকুল ইসলাম নন, একই পরিস্থিতিতে পড়েছেন মোট ২৮১ জন। তাঁরা সবাই মিলে ডিএসসিসির তহবিলে প্রায় ১৯ কোটি টাকা জমা দিয়েছেন। কিন্তু কেউই দোকান বুঝে পাননি।
আক্ষেপ করে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘জমি কেনার সামর্থ্য নেই, ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দোকান কিনতে টাকা দিয়েছিলাম। সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন দায়িত্ব শেষে চলে গেছেন। আরেকজন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস আসলেন। কিন্তু ভবনের কাজ আর শেষ হচ্ছে না।
কবে দোকান বুঝে পাব, সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে সেই জবাবও পাচ্ছি না।’
নির্মাণাধীন বিপণিবিতানে একটি দোকান বরাদ্দ পেয়েছেন মো. মাসুমের বোন সাকিয়া রহমান। মো. মাসুম বঙ্গবাজারে ব্যবসা করতেন। আগুনে পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে তাঁর আটটি দোকান ছিল। তিনি বলেন, ধার করে তাঁর বোন সিটি করপোরেশনকে তিন কিস্তিতে সাত লাখ টাকা দিয়েছেন। কিন্তু মার্কেটের কাজ শেষ হয়নি। দোকান বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। কাজ শেষে কবে দোকান বুঝিয়ে দেওয়া হবে, তা নিয়ে সিটি করপোরেশন কোনো কিছু বলছে না।
রাজধানীর চানখাঁরপুল মোড়ে ৩৮ দশমিক ৬৪ কাঠা জমিতে দুটি বেজমেন্টসহ পাঁচতলা একটি বিপণিবিতানের নির্মাণকাজ চলছে। নির্মাণ করছে ডিএসসিসি। এর নাম রাখা হয়েছে এম এ আজিজ মার্কেট কমপ্লেক্স। এম এ আজিজ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন।
ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বহুতল এ ভবনের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৩২ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের অক্টোবরে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ২০১৯ সালের অক্টোবরেই। বেঁধে দেওয়া সময়ে কাজ শেষ হয়নি। পরে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত এই সময়সীমা বাড়ানো হয়। কিন্তু বেজমেন্টের কাজ করে বাকি কাজ বন্ধ রাখে ঠিকাদার। এরপর থেকে ভবনটি প্রায় পরিত্যক্ত পড়ে আছে।
কমিউনিটি সেন্টারের জন্য ভবনটির নির্মাণকাজ ২০০৬ সালে শুরু হয়েছিল
ভবনটির নির্মাণকাজ শুরুর আগে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আগ্রহীদের আবেদন করতে বলা হয়। আবেদনের পর ২৮১ জন ব্যক্তিকে দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়। তখন সবাই তিন লাখ টাকা করে ডিএসসিসির তহবিলে জমা দেন। এরপর আরেক কিস্তিতে আরও দুই লাখ টাকা করে জমা নেওয়া হয়। আয়তন অনুযায়ী এই মার্কেটে একেকটি দোকানের দাম পড়ছে ১০ থেকে ১৩ লাখ টাকা। বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিদের মোট চার কিস্তিতে এসব টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির রাজস্ব বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ভবনের নির্মাণকাজে অগ্রগতি না থাকলেও টাকা তোলা থেমে নেই। এ কাজ এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত বরাদ্দপ্রাপ্তদের অনেকে পুরো টাকা (চার কিস্তি) ডিএসসিসির তহবিলে জমা দিয়েছেন। অনেকে দুই কিস্তি, অনেকে তিন কিস্তির টাকা পরিশোধ করেছেন। এখন পর্যন্ত ডিএসিসির তহবিলে প্রায় ১৯ কোটি টাকা জমা হয়েছে।
সরেজমিনে যা দেখা গেল
৩ এপ্রিল চানখাঁরপুলে গিয়ে দেখা যায়, ভবনটির বেজমেন্টের ছাদ ঢালাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। পুরো বেজমেন্টে পানি জমে আছে। মশা উড়ছে। ওই পানিতে জন্মেছে মশা। বেজমেন্টের ছাদে রিকশা ও ভ্যানের গ্যারেজ খোলা হয়েছে। সেখানে মুরগি ও কবুতর পালন করা হচ্ছে। চারপাশে টিন দিয়ে নির্মাণাধীন বিপণিবিতানটি ঘিরে রাখা আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকায় নির্মাণাধীন বিপণিবিতানটির নির্মাণসামগ্রী চুরির ঘটনা ঘটছিল। মাদকসেবীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল জায়গাটি। পরে স্থানীয় কাউন্সিলর এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এম এ আজিজের ছেলে ওমর বিন আবদুল আজিজকে বিপণিবিতানটি দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি স্থানীয় কিছু ব্যক্তিকে জায়গাটি দেখভাল করতে বলেছেন। তাঁরাই সেখানে রিকশা এবং ভ্যানের গ্যারেজ বানিয়ে ব্যবসা করছেন।
এ বিষয়ে কাউন্সিলর ওমর বিন আবদুল আজিজ বলেন, জায়গাটি দেখভালের জন্য কয়েকজনকে বলেছি। তাঁরাই সেখানে থাকছেন। নতুন ঠিকাদার নিয়োগ হলে মাসখানেক পর তাঁদের সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে।
নির্মাণকাজ শেষের অপেক্ষা
ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভবনটি নির্মাণের কাজ পেয়েছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দ্য বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েটস লিমিডেট। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল করিম চৌধুরী। তিনি ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় আটক যুবলীগ নেতা জি কে শামীমের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ফজলুল করিম চৌধুরীর এই প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করতেন জি কে শামীম। তাই জি কে শামীম আটক হওয়ার পর ভবনটির নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে একাধিকবার তাগাদা দিলেও তারা কাজ শেষ করেনি। একপর্যায়ে ঠিকাদারের কার্যাদেশ বাতিল, ইতিমধ্যে শেষ হওয়া কাজের খরচ নির্ধারণ করতে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ, চুক্তি অনুযায়ী কাজ শেষ না করার জন্য জরিমানা নির্ধারণ এবং নতুন কার্যাদেশ দিতে বছর দুয়েক সময় চলে যায়। চলতি এপ্রিলে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ দিতে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে।
কবে নাগাদ বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তাঁদের দোকান পেতে পারেন, এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আরিফুল হক বলেন, ভবন নির্মাণের কাজটি প্রকৌশল বিভাগের দায়িত্বে। কাজ শেষ হলে তা সম্পত্তি বিভাগকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। পরে তারাই বরাদ্দপ্রাপ্তদের দোকান বুঝিয়ে দেবেন। তবে কবে নাগাদ ভবনের কাজ শেষ হবে, তা বলা যাচ্ছে না।
ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগ ও সম্পত্তি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা জানান, নতুন ঠিকাদার আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত হয়নি। স্থানীয় কাউন্সিলরের মায়ের নামে থাকা একটি প্রতিষ্ঠানকে বাকি কাজ শেষ করার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। কাজ শেষ করতে প্রায় ২৭ কোটি টাকা লাগবে। নতুন কোনো জটিলতা না হলে আগামী দুই বছরের মধ্যে বাকি কাজ শেষ হবে। (সূত্র- প্রথম আলো)।