জাতিসংঘে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের তৎপরতা নতুন করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তৈরি করেছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে জুলাই বিপ্লব কিংবা ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান। পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনা, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মপরিকল্পনার সমর্থন আদায় করতে তিনি সক্ষম হয়েছেন বলে মনে করেন তারা। তবে সবকিছু ছাপিয়ে কয়েক মাসের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটা গুণগত পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।
নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর যখন স্বাধীন বাংলাদেশের পথচলা শুরু হয়, তখন থেকেই চলতে থাকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা। স্বাধীনতার ঠিক তিন বছর পর ১৯৭৪ সালের এই সেপ্টেম্বর মাসেই আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে বাংলাদেশ। এ যেনো ইতিহাসের আরেক পুনরাবৃত্তি। ৫০ বছর পরের অন্য এক সেপ্টেম্বর মাসেই জাতিসংঘে নতুন এক বাংলাদেশের নতুন পরিচয়। তার পেছনেও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের আরেক ইতিহাস।
আর তাই তো অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করলেন আত্মত্যাগকারী আবু সাঈদ মুগ্ধদের। বিশ্বনেতাদের হাতে হাতে তুলে দিলেন দ্যা আর্ট অব ট্রায়াম্প তথা জুলাই বিপ্লবের চিত্রগাঁথা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. লাইলুফার ইয়াসমিন বলেন, ‘এই প্রথম আমরা দেখছি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একটা পজেটিভ বাংলাদেশ দেখছে। এটার একটা বিশাল ভূমিকা আছে, যারা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতেন না, আসলে কী পরিবর্তন হয়েছে বাংলাদেশে। আমাদের বন্ধুরা যখন বিদেশ থেকে জানতে চাচ্ছে যে আসলে হয়েছেটা কী? এবং কীভাবে এটা হয়েছে। এই জিনিসটা যে ড, ইউনূস একটা প্ল্যাটফর্শে দাঁড়িয়ে বলছেন তখন সেটা বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বলেন, ‘৫০ বছর আগে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের মধ্য দিয়ে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মানিত সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি। তখন কার প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার পর এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা কূটনৈতিক বিজয়। ৫০ বছর পর ড. ইউনূস আবার নতুন এক বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সামনে তুলে ধরছেন। প্রতিটি ঘটনাই বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের এই সংক্ষিপ্ত সফরে বিশ্বনেতাদের কাছে পরিবর্তনমুখী এক নতুন বাংলাদেশের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনুস। আদায় করে নিয়েছেন ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের গ্রহণযোগ্যতা ও বহির্বিশ্বের সমর্থন। যেখানে স্থান পেয়েছে ইউনূস সরকারের স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা।
হুমায়ূন কবির বলেন, ‘তিনি সকলের কাছেই তার সরকারের প্রেক্ষাপট এবং তাদের যে এখন সংস্কার পরিকল্পনা শেষ করার পর নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের উত্তরণ নিয়ে তাদের কাছে সমর্থন চেয়েছেন, তিনি পেয়েছেনও।’
অধ্যাপক ড. লাইলুফার ইয়াসমিন বলেন, ‘বিশ্ব দরবারে নতুন বাংলাদেশে তুলে ধরেছেন যে এটা নতুন বাংলাদেশ ২.০। এবং সেখানে আমার এখন প্রায়োরিটি কী আর লং টাইম প্রায়োরিটি কী? সেটা আমার মনে হয় ইউনূস সরকার যাদের সাথে মিট করেছে তাদের বুঝাতে পেরেছে।’
তারা বলছেন, জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বসে আলাদা করে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ আর্থিক দাতাসংস্থাগুলোর সঙ্গে ড. ইউনূস যে তৎপরতা দেখিয়েছেন। তাতে খুব দ্রুত কোনো সুফল পাওয়া না গেলেও কয়েক মাসের মধ্যেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটা গুণগত পরিবর্তন আসতে শুরু করবে।
হুমায়ূন কবির বলেন, ‘বর্তমান অর্থনৈতিক জায়গা থেকে উত্তরণের জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে যে সহযোগিতা পাওয়া প্রয়োজন বা পাওয়ার সুযোগ আছে সে বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন। আমি মনে করি যে এগুলো ইতিবাচক হয়েছে।’
সফরকালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ অনেক রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে আন্তরিক আলাপ করেছেন। ফলে প্রতিটি দেশের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জোরদার হবে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। সেক্ষেত্রে ইতিবাচক সাড়া পড়বে বিদেশি বিনিয়োগেও ।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট বাইডেন তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তার ওপর যে দায়িত্ব আছে সেটা সুষ্ঠভাবে পালন করবে এবং সেটা সমর্থন করেছেন। খুব অল্প সময়ের হলেও খুব সফল সফর হয়েছেন।’
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতিসংঘে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বহির্বিশ্বের যে সমর্থন আদায় করেছেন, তা বাস্তব অর্থে প্রয়োগ করে নিজেদের সক্ষমতা প্রমান করাই এখন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।