ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর নানান মারণাস্ত্রের নাম জানতে পেরেছে মানুষ। কখনো ভ্যাকিউম বোমা তো কখনো ক্লাস্টার বোমা, আবার কখনো কিনঝাল নামক হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র। তারই ধারাবাহিকতায় বেশ কিছুদিন ধরে উচ্চারিত হচ্ছে ডার্টি বোমার নাম।
রাশিয়া দাবি করছে, তাদের কাছে প্রমাণ আছে ইউক্রেন এই বোমা তৈরি করছে এবং তারা এই বোমা নিজেরাই ব্যবহার করে রাশিয়ার ঘাড়ে দোষ চাপাবে। ওদিকে ইউক্রেনও রাশিয়াকে পাল্টা দোষারোপ করেছে।
বহুল আলোচিত এই ডার্টি বোমা আসলে কী, কিভাবেই বা তৈরি হয় এবং কতটা ভয়ংকর বা বিধ্বংসী চ্যানেল 24-এর পাঠকদের জানাতেই আলজাজিরা ও বিবিসি থেকে তথ্য নিয়ে আজকের প্রতিবেদনটি সাজানো হলো।
কী এই ডার্টি বোমা
চলুন প্রথমেই জেনে নেয়া যাক ডার্টি বোমা কী। প্রযুক্তিগতভাবে ‘রেডিওলজিক্যাল ডিসপারসাল ডিভাইস’ হিসাবে পরিচিত ডার্টি বোমা হচ্ছে এমন এক বিস্ফোরক যাতে ইউরেনিয়ামের মতো বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় পদার্থ থাকে। গঠনগত দিক থেকে এটি সাধারণ টিএনটি বোমার মতোই। কিন্তু এটি বিস্ফোরিত হলে বাতাসে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে দেয় বলে এর প্রভাব ভয়াবহ।
বিস্তৃত এলাকায় তেজস্ক্রিয় দূষণ ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যেই মূলত এই বোমা ব্যবহার করা হয়। আর যদি তেজস্ক্রিয় কণাগুলো খুব সূক্ষ্ম হয় এবং তা প্রবল বাতাসে ছড়িয়ে যায়, তবে তা আরও বেশি ক্ষতির কারণ হতে পারে। এ ধরনের বোমা বেসামরিক নাগরিকদের জন্য বিপজ্জনক ও ভয়ঙ্কর।
যেভাবে তৈরি হয়
এবার জানা যাক কিভাবে তৈরি হয় এই বোমা। এই বোমা মূলত প্রচলিত বিস্ফোরক যেমন ডিনামাইটের সঙ্গে এক বা একাধিক তেজস্ক্রিয় পদার্থ মিশিয়ে তৈরি করা হয়। অর্থাৎ রেডিওঅ্যাকটিভ পাউডার বা পিলেটকে ডিনামাইটের সঙ্গে মিশিয়ে ডার্টি বোমা তৈরি করা হয়।
তবে তেজস্ক্রিয় পদার্থ থাকলেও এটিতে কিন্তু পারমাণবিক বোমার মতো পরিশুদ্ধ তেজস্ক্রিয় পদার্থ ব্যবহার করা হয় না। তার পরিবর্তে হাসপাতাল, গবেষণাগার বা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাওয়া তেজস্ক্রিয় পদার্থ মেশানো হয়। পারমাণবিক বোমার চেয়ে কম সময় ও খরচে তৈরি করা যায় এই বোমা, বহন করাও সহজ।
কোনো এলাকার বেশি ক্ষতিসাধন করতে চাইলে ডার্টি বোমার তেজস্ক্রিয় উপাদানকে গুড়ো বা পাউডারে পরিণত করা হয়। বাতাসের সঙ্গে তেজস্ক্রিয়তা বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলো মিহি গুড়ো করা হয়। এই বোমায় ডিউপ্লিটেড ইউরেনিয়াম ও প্লুটোনিয়াম রাবিশ কিংবা থোরিয়ামের মতো উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয় পদার্থ ব্যবহৃত হয়।
কতটা ভয়াবহ এই ডার্টি বোমা
এ ধরনের তেজস্ক্রিয় বোমার বিস্ফোরণের প্রভাবে ক্যানসারের মতো গুরুতর শারীরিক সমস্যা হতে পারে। এ ধরনের তেজস্ক্রিয় বোমার বিস্ফোরণে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ ধরনের বোমা বিস্ফোরিত হলে ওই অঞ্চলের চারপাশের একটি বিস্তৃত এলাকা দূষণমুক্ত করার জন্য খালি করতে হয়। এমনকি ওই এলাকা সম্পূর্ণ পরিত্যক্তও ঘোষণা করতে হতে পারে।
বেসরকারি বিজ্ঞান গবেষণা সংস্থা ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্ট বলছে, নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে যদি ৯ গ্রাম কোবাল্ট-৬০ এবং ৫ কেজি টিএনটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটে তাহলে পুরো শহর কয়েক দশকের জন্য বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাবে। এই ম্যানহাটান শহরটি আয়তনে প্রায় ঢাকার মিরপুর এলাকার সমান। অর্থাৎ এই সক্ষমতার একটি বোমা মিরপুরের মতো একটি এলাকার পুরোটা বসবাসের অনুপযোগী করে তুলবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বোমার প্রধান প্রভাব হলো মনস্তাত্ত্বিক। এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক অস্ত্র এবং আপনি যখন মানুষকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করবেন তখন আপনি এই ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করবেন। এই বোমা বিস্ফোরিত হলে তার তেজস্ক্রিয় ধূলিকণা এবং ধোঁয়া অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এবং বিস্ফোরণের কেন্দ্রস্থল বা তার আশপাশে নিঃশ্বাস নেয়া হলে তা হবে মারাত্মক বিপজ্জনক।
উল্লেখ থাকে যে, তবে বিশ্বে এ পর্যন্ত ডার্টি বোমা ব্যবহৃত হওয়ার কোনো নজির নেই। যদিও বিশ্বে কয়েকবার ডার্টি বোমা ব্যবহারের চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু সেগুলো সফল হয়নি।