সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৬:০৯ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম :
দুর্গতিনাশিনী দেবীকে বিদায় জানালেন ভক্তরা জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডে জড়িত পুলিশ ছাড় পাবে না: উপদেষ্টা নাহিদ দলে দলে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে ইসরায়েলিরা প্রধান উপদেষ্টার সাথে সেনাপ্রধানের সৌজন্য সাক্ষাৎ রোনালদোর গোল, পর্তুগালের টানা তৃতীয় জয় ২৩ অক্টোবরের মধ্যে হজের নিবন্ধন করার নির্দেশ ধর্ম মন্ত্রণালয়ের শুধু ছাত্রদের আন্দোলনে আলাদা ক্রেডিট দেয়ার সুযোগ নেই : গয়েশ্বর আওয়ামী লীগের বিচার হবে তাঁদের করা আইনেই: জামায়াতের আমির অশ্রুসিক্ত নয়নে দুর্গাকে বিদায় পশ্চিবঙ্গের মানুষের সৌদি আরবের মক্কায় আকস্মিক বন্যা পাকিস্তানে দুই গোত্রের সহিংসতায় নিহত ১১ লেবাননের গ্রামে ইসরায়েলি বাহিনীর অনুপ্রবেশ ঠেকাল হিজবুল্লাহ সৌদি আরব ও আমিরাতের কাছে আমেরিকার আরও অস্ত্র বিক্রি অক্টোবরে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বেড়েছে টি-টোয়েন্টি এশিয়া কাপের জন্য বাংলাদেশ ‘এ’ দল ঘোষণা

ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবে মহাবিপদের শঙ্কা

রিপোর্টারের নাম :
আপডেট : নভেম্বর ২, ২০২২
ডেঙ্গুর মৌসুম আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা

দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। এসময়ে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও চলছে প্রকোপ। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এবার ডেঙ্গু প্রকোপের মৌসুম আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে। থাকতে পারে আরও কয়েক মাস। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দিলেন তারা। জাতীয় কর্মকৌশল প্রণয়ন জরুরী বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

১৯৬৪ সালে দেশে প্রথম এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর দেখা মেলে। তখন এই জ্বরের নাম ছিলো ঢাকা ফিভার। মাঝের প্রায় ৪ দশক খুব একটা দুশ্চিন্তার কারণ ছিলো না মশাবাহিত এই রোগটি।

২০০০ সাল থেকে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে ডেঙ্গু রোগীর দেখা মেলে দেশে। যার বেশিভাগই ঢাকা শহরে। গত কয়েক বছর ধরে বাস্তবে ফল না মিললেও ঘটা করে দুই সিটি কর্তৃপক্ষই কার্যক্রম চালাচ্ছে এডিস নিধনের।

প্রতিদিন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত প্রায় এক হাজার রোগী ভর্তি হচ্ছেন দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে। এছাড়া বাড়িতে থেকেও চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেক মানুষ। যা সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগির হিসাবের বাইরে। ২০১৯ সালে দেশব্যাপী ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিলে নড়ে চড়ে বসেছিলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এরপরই করোনা আসায় সেই কার্যক্রম হয়েছে অনেকটাই ঢিলেঢালা। আর এই সুযোগে বেড়েছে ডেঙ্গু।

করোনা মহামারি শুরুর বছর ২০২০ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা কম ছিল। কিন্তু ২০২১ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২৮ হাজার ৪২৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। এর মধ্যে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়।

করোনা মহামারি শুরুর আগে ২০১৯ সালে এক লাখের বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিল। ২০০০ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় ৫হাজার ৫৫১ জন। মৃত্যু হয় ৯৩ জনের। ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয় ৩৯ হাজার ৭জন। আর এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয় ১৪৮ জনের।

২০০১ সালে আড়াই হাজার লোক ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে ৪৪ জনের মৃত্যু হয়। ২০০২ সালে ছয় হাজার রোগীর মধ্যে ৫৮ জন, ২০০৩ সালে ৪৮৬ জনের মধ্যে ১০, ২০০৪ সালে চার হাজারের মধ্যে ১৩, ২০০৫ সালে এক হাজারের মধ্যে চার, ২০০৬ সালে দুই হাজারের মধ্যে ১১ জন মারা যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়, সচেতনতা বাড়ানো হয় মানুষের মধ্যে। আর এতে ফলও আসে হাতেনাতে, ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত চার বছরে আড়াই হাজার ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হলেও কেউ মারা যায়নি। ২০১১ সালে আবার কিছুটা বাড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ। ওই বছর দেড় হাজারের মধ্যে ছয়জনের মৃত্যু হয়। এছাড়া ২০১২ সালে ৬৭১ জনের মধ্যে একজন, ২০১৩ সালে প্রায় দুই হাজারের মধ্যে দুজন মারা যায় এবং ২০১৪ সালে ৩৭৫ জন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেলেও কেউ মারা যায়নি। এরপর প্রতি বছরই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ২০১৫ সালে তিন হাজারের মধ্যে ছয়জন, ২০১৬ সালে ছয় হাজারের মধ্যে ১৪, ২০১৭ সালে তিন হাজারের মধ্যে আট, ২০১৮ সালে ১০ হাজার ১৪৮ জনের মধ্যে ২৬, ২০১৯ সালে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জনের মধ্যে ১৭৯ জন মারা যায়। ২০২০ সালে দেড় হাজার ব্যক্তি ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেও মৃত্যু হয় চারজনের। আর ২০২১ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় সাড়ে ২৮ হাজার, মারা যায় ১০৫ জন।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ২০১৯ সালে ৬৪ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়েছিল। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ছড়িয়েছে ৫৮ জেলায়। আর ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে পড়া মানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। কেননা জেলাগুলোতে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ বা ডেঙ্গু প্রতিরোধে কোনো জনবল নেই, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগও কম। এমনকি জেলা হাসপাতালগুলোর চিকিৎসকদের এ বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা নেই। বাসিন্দাদের মধ্যেও সচেতনতা কম। ফলে দেখা যাচ্ছে, একক জেলা হিসেবে কক্সবাজারে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তার মানে ওই জেলার ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা সফল হচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে এখন মশাবাহিত বিভিন্ন রোগ সারা বছরই থাকবে। তারমধ্যে ডেঙ্গু অন্যতম।

এডিস মশার যে জীবন চক্র সে হিসেবে অক্টোবর মাস থেকেই ডেঙ্গু রোগী কমে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেও রাজধানীসহ সারাদেশে সরকারি বেসরকারি সব হাসপাতালের ডেঙ্গু বিভাগে তিল ধারণের জায়গা নেই।

কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, মশার যে জীবনচক্র তা পালটে গেছে। এখন সারা বছরময় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব থাকবে বাংলাদেশে।

কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, আমরা গবেষক হিসেবে সবাইকে সতর্ক করে বলতে চাই, এখন সারাবছর ব্যাপী এডিস মশা নিধন কার্যক্রম চলমান রাখতে হবে। অন্যথায় মৌসুমে ডেঙ্গুর অবস্থা খারাপ হবে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপপ্তরের সহকারী পরিচালক এম এম আখতারুজ্জামান বলেন, মশাবাহিত রোগগুলো নিয়ন্ত্রণে আলাদা অধিদপ্তর এবং একটি জাতীয় কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে হবে। দ্রুতই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ও জোরদার পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে বড় মূল্য দিতে হতে পারে বলেও জানান তিনি।

মশক নিধনের দায়িত্বে থাকা ঢাকা দুই সিটির দায়িত্বশীলরা এই পরিস্থিতিতে জন্য জলবায়ুর পরিবর্তনকে দায়ী করছেন।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রি. জে. মো. জোবায়দুর রহমান বলেন, বৃষ্টি যখন দীর্ঘায়িত হয় তখন এডিস মশার প্রজননের জন্যে উৎকৃষ্ট পরিবেশ তৈরি করে। কার্যকরভাবে যদি মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করতে চাই, তবে শুধু সিটি কর্পোরেশন কিছুই করতে পারবে না।

গবেষকদের মতে, মশার জীবন চক্র যেহেতু বদলে গেছে তাই এখন মশক নিধন কার্যক্রমের প্রক্রিয়া ঢেলে সাজাতে হবে। শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশে যদি এডিস মশা নিধনে জোর তৎপরতা চালানো না হয় তাহলে সামনে আরও বিপদ।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জানিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগে যেখানে ডেঙ্গু হয়নি সেখানেও এখন ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।

তাছাড়া হাসপাতালে আসা বেশিরভাগ রোগী আগেও এক বা একাধিকবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছিলেন। তাই এবারের লক্ষণগুলো প্রকট।

তবে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই আছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ভবিষ্যতে পরিস্থিতি সামাল দিতেই হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। কোন প্যানিক তৈরি করতে নয়।”

ঢাকার পরে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলা কক্সবাজারে। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, এবারে ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে অধিকাংশের বয়স ২০ বছরের বেশি। মৃত্যু বেশি ৪০-৫০ বছর বয়সীদের মধ্যে। মারা যাওয়া রোগীদের ৩৫% শিশু অর্থাৎ যাদের বয়স ১৮ বছরের নীচে। আক্রান্ত রোগীকে দেরি করে হাসপাতালে নেয়ায় ভর্তির তিনদিনের মধ্যেই মারা যাচ্ছেন অনেকে।

ঢাকার বাইরেই বেশি মৃত্যু হচ্ছে। এছাড়া নারীদের মৃত্যুহার পুরুষদের তুলনায় বেশি। সাধারণত এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে ডেঙ্গু সেরে যায়। তবে কিছু রোগীর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়তে পারে। অনেক ক্ষেত্রে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।


এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ