চট্টগ্রামে ভূমি অধিগ্রহণ কার্যালয়ের কর্মচারী ছিলেন আহমদ করিম। চেইনম্যান হিসেবে কাজ করতেন। দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৯ সালে করিমকে সন্দ্বীপে ইউএনও কার্যালয়ে বদলি করা হয়। সেখানেও তিনি অনিয়ম বন্ধ করেননি। তার অবৈধ সম্পদের তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই অবস্থায় তিনি এখন দুদককে ফাঁকি দিয়ে সেসব সম্পদ বিক্রি করে আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ (এলএ) শাখায় ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ দুপুরে আকস্মিক পরিদর্শনে গিয়ে সেবা গ্রহীতাদের অভিযোগ শোনেন ভূমি প্রতিমন্ত্রী মো. সাইফুজ্জামান চৌধুরী। সেখানে কয়েকজন সেবাগ্রহীতা তাঁর কাছে কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ করেন। প্রতিমন্ত্রী তাৎক্ষণিকভাবে কয়েকটি অভিযোগ যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নেন। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় কার্যালয়ের কর্মচারী আহমদ করিমকে তাৎক্ষণিক বদলির নির্দেশ দেন তিনি।
ভুক্তভোগীরা ভূমি প্রতিমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে মনছুর আলী নামের এক সেবাগ্রহীতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এই অফিসে টাকা ছাড়া ফাইল নড়ে না। আমি এক বছর ধরে ঘুরছি আমার জমি অধিগ্রহণের টাকার জন্য।’
ওমর উল্লাহ নামের আরেক সেবাগ্রহীতা প্রতিমন্ত্রীকে বলেন, ‘ঘুষ ছাড়া এখানে ফাইল নড়ে না।’ এরপর একে একে আরও আট-নয়জন ভুক্তভোগী মন্ত্রীর কাছে সেবা পেতে তাঁদের ভোগান্তি ও বিড়ম্বনার কথা তুলে ধরেন।
ভূমি অধিগ্রহণ কার্যালয়ের কর্মচারী আহমদ করিম, মো. হানিফ এবং সার্ভেয়ার সৈকত চাকমা ও মো. মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে বেশিরভাগ সেবাগ্রহীতা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ করেন। তাদের প্রধান অভিযোগ ছিল, ভূমি অধিগ্রহণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা সরকারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ যে টাকা পান, সেই টাকা ছাড় করাতে কমিশন নেওয়া হয়।
পরে কার্যালয়ের তিন শিকলবাহক (চেইনম্যান) আহমদ করিম ও মো. হানিফকে তাৎক্ষণিক বদলির নির্দেশ দেন প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। মৌখিকভাবে সতর্ক করেন সার্ভেয়ার সৈকত চাকমা ও মো. মোবারক হোসেনকে। এ ছাড়া রফিক আহমদ নামের এক দালালকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তির নির্দেশ দেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত রফিককে এক হাজার টাকা জরিমানা করেন এবং ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করে দেন।
পরে প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি আহমদ করিমকে কয়েকদিন আগে বদলি করার নির্দেশ দিয়েছিলাম। সেটা এখনো কার্যকর হয়নি। ২০১৯ সালের শেষের দিকে আহমদ করিমকে সন্দ্বীপে বদলি করেন এডিসি দৌলতুজ্জামান খান। এই অনিয়ম ও দুর্নীতির পরপরই দুদক তার (আহমদ করিম) বিষয়ে তদন্তে নামে।
চট্টগ্রাম এল এ শাখা প্রায় সময় খবরের শিরোনাম হয় শিকলবাহক (চেইনম্যান) আহমদ করিমদের নিয়ে। করিম দুদকের তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার আগেই অবৈধভাবে গড়া বিশাল সম্পদ গোপনে বিক্রি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরে তাকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয় সন্দ্বীপ ইউএনও অফিসে।
সন্দ্বীপ ইউএনও জেপি দেওয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘আহমদ করিম অফিসে অনিয়মিত। মাঝে মধ্যে তাকে অফিসে দেখা যায়।’
আহমদ করিমের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের বাশখালী উপজেলায় জলদি এলাকায়। শ্বশুর বাড়ি বইলছড়িতে।
করিমের এলাকার বাসিন্দা নুর মোহাম্মদ জানান, আহমদ করিম অতি সাধারণ পরিবারের ছেলে। তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। তিনি নাকি ডিসি অফিসে চাকরি করেন। চাকরির কয়েক বছরের মধ্যে বিশাল ধন দৌলতের মালিক বনে যান।
করিমের পাঁচতলা বাড়ি দেখিয়ে নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘দুদকের অফিসার আসছে করিমের বাড়িঘর ও তার যাবতীয় খবরাখবর নেয়ার জন্য। আজ প্রায় এক বছর হয়ে গেল, কিন্তু তারতো কোনো বিচার বা শাস্তি হলো না।’
প্রায় এক বছর আগে দুদকের একজন কর্মকর্তা ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে এসে তদন্ত করেন। তদন্ত প্রতিবেদন বিলম্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে এলাকায়। এ বিষয়ে চট্টগ্রামের দুদক অফিসের ডেপুটি ডিরেক্টর চট্টগ্রাম-১ লুৎফল কবির চন্দনের কাছে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
সরজমিনে গিয়ে জানা যায়, আহমদ করিমের গ্রামের বাড়িতে পাঁচতলা একটি বাড়ি করেছেন। নিজের এবং স্ত্রীর নামে-বেনামে অনেক জমিজমা আছে। চট্টগ্রাম শহরে নাছিরাবাদ এলাকায় সানমার গার্ডেন গ্রাভে সি-৩ আলিশান ফ্ল্যাট, জিইসি মোড় অ্যামবাসেডর বিল্ডিংয়ে বিলাশবহুল ফ্ল্যাট, চট্টগ্রাম শপিং কমপ্লেক্সের নিচতলায় ১৯৮ নম্বর ‘সুন্দরম’ নামে একটা দোকান রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সানমার গার্ডেন গ্রাভের সি-৩ প্লাট জনৈক চিকিৎসক মোস্তাফিুজুর রহমানের কাছে এক কোটি ১০ লাখ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন। দুদকের তদন্ত চলমান থাকা অবস্থায় আদালতের অনুমতি ছাড়া গোপনে অভিযুক্ত ব্যক্তির সম্পতি বিক্রি করার বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
এছাড়াও চট্টগ্রাম শপিং কমপ্লেক্সের ১৯৮ নম্বর ‘সুন্দরম’ নামের দোকানও বিক্রি করার গোপনে প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন করিম। দুদকের তদন্তকে ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ বিক্রির চেষ্টায় করছেন তিনি।
‘সুন্দরম’ দোকান চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন থেকে কিনেছেন করিম। চসিকের যাবতীয় দোকান পরিচালনাকারী প্রনব বাবু ঢাকাটাইমসকে জানান, দোকানের নামে কোনো অভিযোগ থাকলে তা চসিকের মেয়র বরাবরে আবেদন করে নিস্পত্তি করার পরে মালিকানা হস্তান্তর করা যাবে। এর আগে কোনোভাবেই মালিকানা পরিবর্তন বা বিক্রি করা অবৈধ।
এসবের সত্যতা যাছাইয়ের জন্য অভিযুক্ত আহমদ করিমের ফোনে গত কয়েকদিন ধরে চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি, তার ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। সোমবার আহমদ করিম এই প্রতিবেদককে ফিরতি ফোন করেন এবং সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ফোনে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
ঢাকা টাইমসের সৌজন্যে