রাজধানীর বঙ্গবাজারসহ স্থানীয় ছয়টি মার্কেটে মঙ্গলবার লাগা আগুন প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে এসেছে।আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে তিনটি প্রতিবন্ধকতার কথা বলেছে ফায়ার সার্ভিস। এসব কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হয়েছে বলে জানায় সংস্থাটি।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এ ঘটনায় প্রায় ৫০০০ দোকান পুড়ে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির দাবি করেছে।
তবে ফায়ার সার্ভিস ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) প্রাথমিকভাবে অগ্নিকান্ড ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির জন্য স্থানীয় ব্যবসায়ীদেরই দায়ী করেছেন। তাদের দাবি, মার্কেটটিকে ২০১৯ সালে ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যবহারের অনুপযোগী ঘোষণা করে ব্যবসায়ীদের জানানো হয়েছিল। কিন্তু তাদের অসহযোগিতার কারণে, মার্কেটটিকে পূন:নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে, রাজধানীর বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা উঠে এসেছে একনেক সভার আলোচনায়। এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার এক পর্যায়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বারবার আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি এর সমাধানে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন।
মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনার বিষয়টি সভা শেষে ব্রিফিংয়ে তুলে ধরেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
মঙ্গলবার দুপুরে গণমাধ্যমকর্মীদের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মাইন উদ্দিন বলেন, সকাল ৬.১০টায় আগুন লাগে। দুপুর ১২.৩৬টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এখন আর আগুন ছড়াবে না। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ৪৮টি ইউনিট কাজ করেছে। তবে পুরোপুরি নির্বাপণ করতে আরও কিছু সময় লাগবে। প্রতিটি ভবন ও ঘরে গিয়ে আগুন আছে কি না, তা পরীক্ষা করতে হবে।
এর আগে মঙ্গলবার সকাল ৬টার দিকে রাজধানীর বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণের কথা জানান ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক। তবে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বিকেল সাড়ে চারটা নাগাদ আগুন পুরোপুরি নেভেনি।
আগুন নেভাতে সকাল থেকে ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিট কাজ করছে। পাশাপাশি সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যরাসহ র্যাব, বিজিবি ও ওয়াসার সদস্যরাও আগুন নিয়ন্ত্রণ কাজে অংশ নেন।
একনেক সভার বরাত দিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, সভায় বঙ্গবাজারে আগুনের বিষয়টি আলোচনায় আসে। প্রধানমন্ত্রী এ নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করেন। তিনি অনেক কষ্ট পেয়েছেন, অনেক আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। এতোগুলো পরিবার ঈদ সামনে রেখে কী করবে, এই ভেবেও প্রধানমন্ত্রী অনেক কষ্ট অনুভব করেন।
অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সরকার কোনো সহায়তা দেবে কি না, জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, বিষয়টি আমার পরিষ্কার জানা নেই। তবে আমার মনে হয় কিছু একটা করা হবে।
এদিকে অগ্নিকাণ্ডে এখনো কারও প্রাণহানির খবর পাওয়া না গেলেও উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া ফায়ার সার্ভিসের একাধিক সদস্য আহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। মার্কেটের অধিকাংশ দোকানের মালামাল পুড়ে গেছে। ঈদ ঘিরে ব্যবসায়ীরা চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
ব্যবসায়ীদের অনেকে জানিয়েছেন, তারা ঈদ সামনে রেখে ঋণ ও ধারদেনা করে দোকানে নতুন মালামাল তুলেছিলেন। আগুন লাগার ঘটনায় তাদের অনেকে নিঃস্ব হয়ে গেছেন।
গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে তিনটি প্রতিবন্ধকতার কথা বলেছেন মহাপরিচালক। তিনি বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে প্রধান বাধা ছিল উৎসুক জনতা। পানির স্বল্পতা ও বাতাসের কারণেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করে বলেন, উৎসুক জনতার কারণে কাজ করতে সমস্যা হয়েছে। তিনি তাঁর নিজের করা একটি ভিডিও গণমাধ্যমকর্মীদের দেখিয়ে বলেন, ‘কোন জায়গা দিয়ে আমরা ফায়ার সার্ভিস কাজ করব। কোথায়, কীভাবে ফায়ার সার্ভিসের লোক কাজ করবে? আমরা তো আপনাদের জন্যই জীবন দিচ্ছি।’
আগুন নেভাতে পানির স্বল্পতার কথা বলেন মাইন উদ্দিন বলেন, সেনাবাহিনী পানির বাউজার এনে এবং ওয়াসাও পানির বিষয়ে সহায়তা করেছে। আর ঘটনাস্থলে অনেক বাতাস ছিল। বাতাসে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আগুন চলে যায়। এর ফলে নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হয়েছে।
আগুনের উৎস সম্পর্কে তদন্তের আগে কিছু জানানো যাবে না বলে জানান মো. মাইন উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘২০১৯ সালের ২ এপ্রিল এই ভবন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ব্যানার টানিয়েছিলাম। ১০ বার নোটিশ দিয়েছি, করণীয় যা যা করেছি। তারপরও ব্যবসা চলছিল।’
এ বিষয়ে অন্য সংস্থার গাফিলতি থাকলে তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলেন তিনি। আগুন নির্বাপণের পর পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলেও জানান তিনি।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সাধারণ জনগণ আহত হওয়ার তথ্য জানা নেই বলে জানান মো. মাইন উদ্দিন। ফায়ার সার্ভিসের আটজন আহত হয়েছেন বলেও জানান তিনি। দুজনকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁদের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
ফায়ার সার্ভিসের কন্ট্রোল রুমে হামলা প্রসঙ্গে মাইন উদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বঙ্গবাজার আর ফায়ার সার্ভিসের হেডকোয়ার্টার রাস্তার এপাশ আর ওপাশ। সাড়ে ছয়টায় আমি ঘটনাস্থলে এসেছি। ডিজি হিসেবে জনগণের জানমালের উদ্ধারে জীবন দিচ্ছি। কেন বা কারা ফায়ার সার্ভিসের অফিসে আঘাত করল, তা আমার বোধগম্য নয়। আমি মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণকে বলতে চাই, ফায়ার সার্ভিস যেকোনো দুর্যোগে সবার আগে পাশে দাঁড়ায়। কেন এই আক্রমণ, আঘাত—এই প্রশ্ন আপনাদের কাছে রাখছি।’
মহাপরিচালক মো. মাইন উদ্দিন আরও বলেন, ফায়ার সার্ভিসের অফিসার, সব স্তরের কর্মচারীরা মানুষের জন্য জীবন দেন। গত এক বছরে ১৩ জন শহীদ হয়েছেন এবং তাঁরা অগ্নিবীর খেতাব পেয়েছেন। ২৯ জন আহত হয়েছেন। আর আজ আটজন আহত হলেন।
তদন্তের পর অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কতটা, তা জানাতে পারবেন বলে জানান মহাপরিচালক। ফায়ার সার্ভিস ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করবে বলে জানান তিনি।
এক ব্যক্তির মুঠোফোন নম্বর ও জরুরি সেবা ৯৯৯ থেকে প্রথমে আগুনের খবর পেয়েছিলেন বলে জানান মো. মাইন উদ্দিন। আগুন নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট, বিজিবি, পুলিশ, ওয়াসা, গণমাধ্যমকর্মীসহ অনেকে সহায়তা করেছেন বলে জানান তিনি।
রাজধানীর বঙ্গবাজারে আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের ৬ সদস্যসহ ১১ জন আহত হয়েছেন। আহত অবস্থায় তাঁরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে এসেছেন। আহত সদস্যদের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
আজ মঙ্গলবার সকাল ৬টা ১০ মিনিটে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। সকাল ৮টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের ৪১টি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। এরপর ৪৩টি ইউনিট যাওয়ার খবর জানায় ফায়ার সার্ভিস। সকাল সোয়া ১০টার দিকে ফায়ার সার্ভিস বলেছে, তাদের ৫০টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করছে।
বঙ্গবাজারের আগুনে ফায়ার সার্ভিসের আহত সদস্যরা হচ্ছেন—রবিউল ইসলাম অন্তর (৩০), আতিকুর রহমান রাজন (৩৫), মেহেদি হাসান (২৮), ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক বাবুল চক্রবর্তী (৫৮) ও সোহেল (৪৮)। এর মধ্যে মেহেদি হাসানকে শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে।
এ ঘটনায় আহত অন্য ব্যক্তিরা হচ্ছেন—নিলয় (৩৫), শাহিন (৪০), রিপন (৪০), রুবেল (৩২), দুলাল মিয়া (৬০) , মো. সুমন মিজি (৪৮) ও বঙ্গবাজারের গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও মো. সোহেল (৪৮)।
আগুনের ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মো. বাচ্চু মিয়া। তিনি বলেন, আটজন ঢামেক হাসপাতালে ও একজন শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। তাঁদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে, তবে কেউ গুরুতর আহত নন।
বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি ফায়ার সার্ভিসের কর্মী মেহেদি হাসান ধোয়ায় অসুস্থ হয়েছেন বলেও জানান বাচ্চু মিয়া।
বঙ্গবাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণ আনতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সম্মিলিত সাহায্যকারী দল, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সাহায্যকারী দল ও একটি হেলিকপ্টার কাজ করছে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।