বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে যুক্তরাজ্য। পাশাপাশি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুত্ব দিয়েছে দেশটি। বৃহস্পতিবার (৯ সেপ্টেম্বর) লন্ডনে অনুষ্ঠিত দুই দেশের চতুর্থ কৌশলগত সংলাপে যুক্তরাজ্য এ অবস্থান তুলে ধরেছে।
যুক্তরাজ্য-বাংলাদেশ কৌশলগত সংলাপের নেতৃত্বে ছিলেন দেশটির ফরেন কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসের (এফসিডিও) স্থায়ী আন্ডার সেক্রেটারি ফিলিপ বার্টন এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন।
শুক্রবার (১০ সেপ্টেম্বর) ঢাকায় যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, এফসিডিও এর বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে উঠে আসা বাংলাদেশের মানবাধিকার সম্পর্কিত কিছু বিষয় (যেমন: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রভাব, বিধিবহির্ভূত আটক, বিধিবহির্ভূত বিচারপ্রক্রিয়া, এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড) নিয়ে যুক্তরাজ্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। উভয় দেশই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের গুরুত্ব, জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থার উন্নয়নে সুশীল সমাজের উপস্থিতি ও মতপ্রকাশ ও ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়ে একমত হয়েছে।
এর আগে, যুক্তরাজ্য-বাংলাদেশ কৌশলগত সংলাপ নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে। পরে আলাদা আরেকটি বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে ঢাকায় যুক্তরাজ্য হাইকমিশন।
ঢাকায় যুক্তরাজ্য হাই কমিশনের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সংলাপে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ইস্যু, বাণিজ্য, অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন অংশীদারিত্ব, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষাসহ যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে কার্যকর মতবিনিময়।
যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ, উভয় পক্ষ ২০১৯ সালের পর প্রথমবারের মতো সশরীরে সাক্ষাতের সুযোগকে স্বাগত জানিয়ে সংলাপ শুরু করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির বছরে অনুষ্ঠিত এবারের কৌশলগত সংলাপ যুক্তরাজ্য-বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করেছে। উভয় দেশের প্রতিনিধিরা যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্যে গভীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রবাসী সংযোগ ও কমনওয়েলথের সদস্যপদের কারণে মানুষের সঙ্গে মানুষের সুদৃঢ় সম্পর্কের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালীন যারা প্রিয়জন হারিয়েছেন, তাদের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন এই সংলাপে অংশগ্রহণকারী সদস্যরা। দেশব্যাপী কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনার জন্য যুক্তরাজ্য বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানায়।
সংঘাত প্রতিরোধ, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা, নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা সমর্থনসহ বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একে অপরকে সহযোগিতা করতে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ সম্মত হয়েছে। দ্বিপাক্ষিক সামরিক সহযোগিতার বিষয়ে উভয় দেশই প্রশিক্ষণ, পেশাগত সামরিক শিক্ষা ও ইন্সট্রাকশনাল এক্সচেঞ্জসহ যৌথ সহযোগিতাকে স্বাগত জানায় এবং এ বছরের শেষের দিকে একটি প্রতিরক্ষা বিষয়ক সংলাপ উদ্বোধনের আশা ব্যক্ত করেন।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায়, যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ বিশ্বের সব দেশকে আরও দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে। গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে বাংলাদেশের প্রচেষ্টার প্রশংসা করে যুক্তরাজ্য। আগামী বছরগুলোতে কার্বন নির্গমন হ্রাস ও ২০৫০ সালের মধ্যে নেট-জিরো নির্গমনসহ একটি নিট জিরো টার্গেট ও কয়লা শক্তির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা জন্য বাংলাদেশের নেতৃত্বকে আরও উত্সাহিত করে।
বিভিন্ন উৎস থেকে আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করতে যুক্তরাজ্যের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ। গত বছরের জানুয়ারিতে উদ্বোধন হওয়া ইউকে-বাংলাদেশ ক্লাইমেট পার্টনারশিপের জন্য উভয় দেশই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
ঢাকায় যুক্তরাজ্য হাই কমিশনের বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার জন্য জাতিসংঘের সুপারিশ লাভ করায় বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানিয়েছে যুক্তরাজ্য। এই উত্তরণকে সফল করতে বাংলাদেশ যেন তাদের রফতানিভিত্তিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে পারে, তাই যুক্তরাজ্য ২০২৯ পর্যন্ত তাদের দেশের বাজারে বাংলাদেশের জন্য শুল্কমুক্ত (duty-free) ও কোটা মুক্ত (quota free) প্রবেশাধিকার অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা লাভ করলে উভয় দেশ তাদের উন্নয়ন অংশীদারিত্বের ভবিষ্যৎ রূপ নিয়ে আলোচনায় বসবেন বলে সম্মত হয়েছেন।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগকারী হিসেবে যুক্তরাজ্য ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউকে-বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ডায়লগের উদ্বোধনকে স্বাগত জানিয়েছে। বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশের উন্নতির গুরুত্ব এবং বাজার প্রবেশাধিকার বাধা হ্রাস করার ওপর যুক্তরাজ্য জোর দিয়েছে। এতে করে উভয় দেশ লাভবান হবে।
উভয় দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় অভিবাসন ও সম্পর্কের গভীরতাকে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ স্বাগত জানায়। চলাচল ও অভিবাসন বিষয়ক একটি পার্টনারশিপ গঠনে যুক্ত হতে উভয় দেশ সম্মত হয়েছে। যুক্তরাজ্য তাদের নতুন পয়েন্টভিত্তিক অভিবাসন ব্যবস্থায় (the new points-based immigration system) প্রদত্ত সুযোগগুলো উল্লেখ করে। দুই দেশের মধ্যে উচ্চশিক্ষা বিষয়ক অংশীদারিত্ব বাড়াতে যুক্তরাজ্য বাংলাদেশকে ‘ক্রস বর্ডার উচ্চশিক্ষা আইন’ বাস্তবায়নের অনুরোধ জানায়।
রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সহিংসতার শিকার হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে। রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে, মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসনের লক্ষ্য নিয়ে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে। যুক্তরাজ্য রোহিঙ্গাদের কল্যাণের দিকে মনোনিবেশ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয় এবং উল্লেখ করে যে, শিক্ষা ও জীবিকার সুযোগ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রস্তুত ও বাংলাদেশে থাকাকালীন মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনে সাহায্য করবে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে উভয় দেশ আসিয়ান ও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের লক্ষ্যে উভয় দেশ দীর্ঘমেয়াদী প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের উপায় নিয়ে আলোচনা করে। যুক্তরাজ্য কারিগরি সহায়তা দেওয়া ও প্রোগ্রামের মাধ্যমে কীভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রমের প্রভাব উন্নত, জনস্বাস্থ্য পরিষেবাগুলোকে আরও মজবুত এবং জলবায়ু পরিবর্তন সঙ্কট মোকাবিলায় সাহায্য করতে পারে তা তুলে ধরে।
সবশেষে উভয় দেশ এ সংলাপের মাধ্যমে গঠনমূলক আলোচনাকে স্বাগত জানায়। পরবর্তী বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য কৌশলগত সংলাপ ২০২২ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার আশা ব্যক্ত করেন।