বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫, ০৯:২৮ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম :
তথ্য গোপন করে জুলাই অভ্যুত্থানের সুবিধা নিলে ২ বছরের কারাদণ্ড সংসদ নির্বাচনে ব্যালট প্রকল্পে ২ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেবে অস্ট্রেলিয়া তথ্য এখন জাতীয় নিরাপত্তার কৌশলগত অস্ত্র: পরিবেশ উপদেষ্টা আনিসুল হক-মোশাররফ হোসেন রিমান্ডে আসছে সাত কলেজের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি হত্যা মামলায় ২ দিনের রিমান্ডে আইভী ‘দখল-চাঁদাবাজি করে বিএনপি যেন আওয়ামী লীগ না হয়, লক্ষ্য রাখবেন’ গণতন্ত্রের জন্য অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন জরুরি: রিজভী ‘এসএসএফকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করতে হবে’ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মুশফিকের বিরল রেকর্ড আর কাউকে হারাতে পারছে না ইন্তের মিলানো মধ্যপ্রাচ্যে আরও যুদ্ধবিমান পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ইরানে নজিরবিহীন হামলায় যুক্তরাষ্ট্র যোগ দেবে : ইসরাইল ‘সন্ত্রাসী ইহুদিবাদীদের’ কঠিন জবাব দেবে ইরান: খামেনি ইরান ইস্যুতে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে ট্রাম্পের বৈঠক: হোয়াইট হাউস

বারোমাসি আম চাষে লাখ টাকা বগুড়ার মামুনের

রিপোর্টারের নাম :
আপডেট : মার্চ ৩০, ২০২২

বৃত্তান্ত প্রতিবেদক: অসময়ের বারোমাসি আমের গাছ মুকুলে ভরা। অনেক গাছে আমের গুটিও এসেছে। চৈত্র মাসের এ সময়ে এটা খুবই পরিচিত দৃশ্য।

কিন্তু বগুড়ার শেরপুরের মাগুরাচাইড় গ্রামের মামুনুর রশীদের আমবাগানের দৃশ্য ভিন্ন। তার প্রায় ৪৫ বিঘার আমের বাগান। তাঁর বাগানের গাছগুলো পাকা আমে ভরা। এই আমের নাম ‘কাটিমন’। এটি থাইল্যান্ডের আমের একটি জাত। কাটিমনের পাশাপাশি মামুনুরের বাগানে দেশি ‘বারি-১১’ জাতের মৌসুমের বাইরের আমও আছে।

শেষ হওয়া শীতকালজুড়ে মৌসুমের বাইরের এই আম বিক্রি করেছেন স্নাতকোত্তর করা তরুণ খামারি মামুনুর। এখনো তাঁর বাগানের গাছে অন্তত লাখখানেক আম আছে।

মামুনুর বলেন, ‘শীতের সময় ২৫০ টাকা কেজি দরে অসময়ের আম বিক্রি শুরু করি। এখন তা বিক্রি করছি ৫৫০ টাকা করে। এবার এখন পর্যন্ত ২৫ লাখ টাকার অসময়ের আম বিক্রি করেছি।’

বগুড়ার শেরপুরের মামুনুর ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানের অনেক খামারি এবার মৌসুমের বাইরের আম বিক্রি করে ভালো লাভ করেছেন বলে জানা গেছে। কারণ, এবার এই আমের ফলন যেমন ভালো হয়েছে, তেমনি দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে প্রায় সাত বছর ধরে দেশি-বিদেশি ‘বারোমাসি’ আম চাষ হচ্ছে।

‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন’ নামে অধিদপ্তরের একটি প্রকল্প আছে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য আমসহ বিভিন্ন ফল মৌসুমের বাইরে সারা বছরই উৎপাদন করা।

অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, সর্বশেষ শীত মৌসুমে দেশের বিভিন্ন স্থানে ১ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে কাটিমন জাতের আমের চাষ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে ৬ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন কাটিমন আম। আর বারি-১১ আমের চাষ হয়েছে ১২০ হেক্টর জমিতে। এই আমের উৎপাদন হয়েছে ৪৮০ মেট্রিক টন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতা নিয়েই অসময়ের আমের বাগান শুরু করেছিলেন মামুনুর। শুরুটা ২০১৬ সালে।

মামুনুরের এই আমের বাগানের আমগুলো ‘ফ্রুট ব্যাগ’ দিয়ে মোড়ানো থাকে। তাঁর বাগানের বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে কোনো রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না।

মানুনুর বলেন, ‘বাজারে অসময়ের আমের ব্যাপক চাহিদা আছে। মানুষের আয় বেড়েছে, তাই এই আমের দাম একটু বেশি হলেও মানুষ তা কিনে খাচ্ছে।’

রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি স্থানীয়ভাবেও অসময়ের আমের যথেষ্ট চাহিদা আছে বলে জানান নাটোরের বাগাতিপাড়ার জামনগর গ্রামের খামারি গোলাম মাওলা। জামনগর গ্রামে তাঁর কাটিমন আমের বড় বাগান আছে। এবার তিনি অন্তত পাঁচ লাখ টাকার কাটিমন আম বিক্রি করেছেন।

গোলাম মাওলা বলেন, ‘এখন ৫০০ টাকা কেজি দরে এই আম বিক্রি করছি। দাম বেশি হওয়া সত্ত্বেও অসময়ের আম নিয়ে বাজারে ক্রেতাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়।’

এখন অসময়ের আম যাঁরা চাষ করছেন, তাঁদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বড় খামারিদের সংখ্যাই বেশি। এ ধরনের আমের চাষ সাধারণ কৃষকের মধ্যে ততটা জনপ্রিয়তা পায়নি। সাধারণ কৃষক পর্যায়ে জনপ্রিয়তা না পাওয়ার পেছনে এই ধরনের আমের চাষ সম্পর্কে অল্প ধারণার পাশাপাশি কিছু ভ্রান্ত কথা দায়ী বলে মনে করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরের খামারি রফিকুল ইসলাম।

রফিকুলের ১২০ বিঘা আয়তনের আমবাগান আছে। তাঁর বাগানের বেশির ভাগই কাটিমন জাতের আমগাছ। এবার তিনি ৩০ লাখ টাকার আম বিক্রি করেছেন। এখনো ৪০ থেকে ৪৫ লাখ টাকার কাটিমন আম তাঁর বাগানে আছে। এই আম পবিত্র রমজান এলে বাজারে ছাড়বেন বলে জানান তিনি।

রফিকুল বলেন, ‘অসময়ের আমের জন্য ভিন্ন পরিচর্যার দরকার হয়, যেটা মৌসুমের আমের ক্ষেত্রে হয় না। এখানে প্রচুর জৈবসার ব্যবহার করতে হয়। নিয়ম মেনে প্রুনিং (কলম) করতে হয়। এ জন্য কিছু কারিগরি জ্ঞানের দরকার হয়, যেটা অনেক কৃষকের নেই। এসব কারণে সাধারণ কৃষক পর্যায়ে অসময়ের আমের চাষ এখনো জনপ্রিয়তা পায়নি।

রফিকুল জানান, তাঁর দেখাদেখি কয়েকজন খামারি অসময়ের আম চাষের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাঁরা তেমন সফল হতে পারেননি। অনেকেই দ্রুত ফলন চান। কিন্তু এই জাতের আমগাছের কখন কী দরকার, সেটা তাঁরা না বুঝে দেদার বিভিন্ন জিনিস দিয়ে থাকেন। এতে হিতে বিপরীত ফল হয়।

এই আম চাষে সাধারণ কৃষকের কম আসার কারণ হিসেবে অজ্ঞতাও একটি বিষয় বলে মনে করেন নাটোরের খামারি গোলাম মাওলা। তাঁর ভাষ্য, অসময়ের আমের স্বাদ কম হবে, উৎপাদন কম হবে বলে একটি ভুল ধারণা আছে। কিন্তু বারি-১১ বা কাটিমন আমের স্বাদ দারুণ। এমন ভুল ধারণাগুলো ভাঙলে এই ধরনের আম চাষে অনেকে এগিয়ে আসবে বলে মনে করেন তিনি।

অসময়ের আম মূলত দেশের বাজারেই বিক্রি হচ্ছে। তবে গোলাম মাওলা জানালেন, এবার তাঁর বাগান থেকে ২০ কেজির মতো অসময়ের আম ব্যক্তি পর্যায়ে তুরস্কে গেছে। সেখান থেকে তিনি ভালো সাড়া পেয়েছেন। এর মাধ্যমে তাঁর অসময়ের আম বিদেশে রপ্তানির একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে আম-জাম-কাঁঠাল-লিচুসহ প্রায় ৬১ শতাংশ মৌসুমি ফল তিন থেকে সাড়ে তিন মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। বছরের বাকি সময়ে মানুষ যাতে এ ধরনের ফল খাওয়ার সুযোগ পায়, পুষ্টির উন্নয়ন ঘটে, সে জন্যই ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন’ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে বলে নথিতে উল্লেখ আছে।

প্রকল্পটির পরিচালক মেহেদী মাসুদ বলেন, ‘আমরা অসময়ে আমের উৎপাদনকে জনপ্রিয় করতে চাই। আমরা চাই, মানুষ যেন সারা বছর আম খেতে পারে। দেশের বাজারের চাহিদা মিটিয়ে এই আম আমরা বিদেশেও রপ্তানি করতে চাই। এখন চাষিরা যে হারে অসময়ের আমে লাভ করছেন, তাতে অন্যরাও ধীরে ধীরে উৎসাহিত হচ্ছেন।’

অসময়ের আমের ক্ষেত্রে বারি-১১ ও কাটিমন বছরে তিনবার ফল দেয় বলে জানা গেছে। বারি-১১ উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি)। এই জাতের প্রতিটি আমের ওজন ৩০০ থেকে ৩৫০ গ্রাম হয়ে থাকে। অন্যদিকে, থাইল্যান্ডের কাটিমন জাতের প্রতিটি আমের ওজন হয় ২৫০ থেকে ৩০০ গ্রাম।

মেহেদী মাসুদ জানান, বারি-১১ ও কাটিমনের বাইরে আগাম ও নাবি জাতের দেশি কিছু আমের জাতের সম্প্রসারণ নিয়ে কাজ হচ্ছে। আগাম জাতগুলোর মধ্যে আছে গোবিন্দভোগ, চৈতি, সুরত বোম্বাই, গোলাপখাস। আর নাবি জাতের মধ্যে আছে বারি-৪, গৌড়মতি, জাদুভোগ।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের রফিকুলের বাগানে ১৫ হাজার গৌড়মতির জাতের আমগাছ আছে। এ বছর তিনি এই জাতের আম বেচে ৬ লাখ টাকা আয় করেছেন বলে জানান।

প্রাকৃতিক কারণেই অসময়ের, বিশেষ করে শীতকালে আম চাষ কৃষকের জন্য ইতিবাচক বলে মনে করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘দেশে শীতকালে ঝড় বা শিলাবৃষ্টির ঝুঁকি কম। এতে কৃষক অন্তত একটি বাড়তি চিন্তা থেকে বেঁচে যায়। মৌসুমি আমের তুলনায় অসময়ের আমের দাম অনেক বেশি হওয়ায় কৃষক আর্থিকভাবে লাভবানও হচ্ছে। সার্বিকভাবে স্থানীয় অর্থনীতির জন্য এই আম চাষ ভালো।’


এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ