শ্রীলঙ্কা সরকারের কিছু উচ্চভিলাসী কর্মকাণ্ড এবং করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশটি আজ চরম অর্থনৈতিক সংকটে নিপতিত হয়েছে। দেশটিতে হাজার হাজার মানুষ গত কয়েক মাস ধরে বিক্ষোভ সহিংসতা চালিয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পদত্যাগ করেছে দেশটির প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে।
কিন্তু এক দশকেরও বেশি সময় ধরে শ্রীলংকার রাজনীতিতে ছিল যে পরিবারের বিরাট আধিপত্য, আজ সেই পরিবারই পড়েছে বিরাট পতনের মুখে। একসময় শ্রীলংকার সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি জাতিগোষ্ঠীর কাছে মাহিন্দা রাজাপাকসে ছিলেন বীর নায়ক। কারণ তিনি প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ২০০৯ সালে তামিল বিদ্রোহীদের নির্মমভাবে দমনের মাধ্যমে তিন দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি টেনেছিলেন।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপর যেসব বড় বড় বিজয় শোভাযাত্রা এবং জনসভা হয়েছিল, সেগুলোতে তাকে সিংহলি বৌদ্ধ রাজাদের সঙ্গে তুলনা করা হতো।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক কুশল পেরেরা বলেন, ‘স্বাধীনতা উত্তর শ্রীলংকায় তিনি ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় সিংহলি বৌদ্ধ নেতা। অনেকে তো তাকে এমনকি সম্রাট মাহিন্দা বলেও প্রশংসা করতো।’
শ্রীলংকা এখন এক সন্ধিক্ষণে- এক তীব্র অর্থনৈতিক সংকট দেশটির ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের জীবনে ওলট-পালট ঘটিয়ে দিয়েছে। শ্রীলংকার গৃহযুদ্ধে বিজয়ের পর রাজাপাকসেদের একসময় বীর হিসেবে বন্দনা করেছে অনেকে, কিন্তু এখন তারা শ্রীলংকার সবচেয়ে ধিক্কৃত এবং সমালোচিত রাজনীতিকে পরিণত হয়েছেন। কীভাবে এরকম ঘটলো এবং এর পর কী ঘটতে যাচ্ছে?
এপ্রিলের শুরু থেকে শ্রীলংকায় প্রেসিডেন্ট গোটাভায়া রাজাপাকসে এবং তার ভাই, প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবি জানাতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা। শ্রীলংকার অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদেরকে দায়ী করা হচ্ছিল। কিন্তু এ সপ্তাহে পরিস্থিতি একেবারে নাটকীয় মোড় নিল।
প্রথমত, সরকার বিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর মাহিন্দা রাজাপাকসের সমর্থকরা হামলা চালানোর পর দেশজুড়ে তীব্র সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লো। এরপর প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসেকে পদত্যাগ করতে হলো। এক ডজনের বেশি রাজনীতিকের বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হলো- এর মধ্যে কিছু বাড়ি ছিল রাজাপাকসেদের।
বিক্ষুব্ধ জনতা ৭৬-বছর বয়সী রাজাপাকসের সরকারি বাসভবনও ঘেরাও করেছিল, সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে আনতে হয়। এখন তিনি নিজের নিরাপত্তার জন্য শ্রীলংকার উত্তর-পূর্বে একটি নৌ-ঘাঁটিতে গিয়ে লুকিয়ে আছেন। শ্রীলংকার আদালত তার দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। যিনি দুই দুইবার শ্রীলংকার প্রেসিডেন্টও ছিলেন, তার জন্য এটি এক বিরাট অবমাননা।
কিন্তু পদত্যাগ করে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালেও মানুষের ক্ষোভ কমেনি, তার ৭২-বছর বয়সী ছোট ভাই, প্রেসিডেন্ট গোটাভায়া রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভকারীরা অটল।
কিন্তু প্রেসিডেন্ট এখন পর্যন্ত পদত্যাগের দাবি উপেক্ষা করেছেন, তবে তাকে বাধ্য হয়ে কিছু ছাড় দেয়ার প্রস্তাব দিতে হয়েছে। প্রেসিডেন্ট গোটাভায়া রাজাপাকসে তার কিছু নির্বাহী ক্ষমতা পার্লামেন্টের কাছে হস্তান্তরে রাজী হয়েছেন। তিনি ঝানু রাজনীতিক রানিল বিক্রমাসিংহেকে নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেছেন একটি সর্বদলীয় সরকার গঠনের লক্ষ্যে।
কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখনো সুতায় ঝুলছে। অনেকে মনে করেন, তাকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর শ্রীলংকা যখন এ যাবতকালের সবচেয়ে শোচনীয় অর্থনৈতিক সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছে, তখন দেশটিতে এরকম রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা পরিস্থিতিকে আরও ভয়ংকর করে তুলতে পারে।
তাঁর বাবা ছিলেন একজন সংসদ সদস্য এবং মাহিন্দা সংসদে একজন বিরোধী নেতা থেকে ২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হন। এক বছর পর তিনি যখন প্রেসিডেন্টের পদে আসীন হন, তখন তার ভাই গোটাভায়াকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী নিয়োগ করেন। গোটাভায়া শ্রীলংকার সামরিক বাহিনী থেকে অবসরে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে নিভৃত জীবনযাপন করছিলেন। তার জন্য এটা ছিল এক বিরাট রাজনৈতিক উত্থান।
তিনি দেশে ফিরে তার ভাইয়ের সরকারে যোগ দিলেন এবং বিরাট খ্যাতি অর্জন করলেন তার নিষ্ঠুরতার জন্য। এরপর রাজাপাকসের পরিবারের আরও অনেক ভাই এবং আত্মীয়-স্বজন সরকারে যোগ দিলেন। তবে রাজাপাকসে সাম্রাজ্যের মূল ব্যক্তি ছিলেন মাহিন্দা, বলা যেতে পারে তিনিই এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা।
এ পর্যন্ত দুই ভাইকে সবসময় ঐক্যবদ্ধই দেখা গেছে। কিন্তু সম্প্রতি তাদের মধ্যে সম্পর্কে ফাটল দেখা যাচ্ছিল। বিশেষ করে যখন গোটাভায়া তার ভাই মাহিন্দাকে বিক্ষোভাকারীদের দাবির মুখে পদত্যাগ করতে বলেন সব কিছুর দায় নিয়ে।
মাহিন্দা রাজাপাকসের জন্য এটি ছিল এক বিরাট অপমান, কারণ তিনিই তার ছোটভাই গোটাভায়াকে ক্ষমতায় এনেছেন। রাজনীতি থেকে তাকে এভাবে বিদায় নিতে হবে সেটা তিনি কখনো কল্পনাও করেননি।
তবে মাহিন্দার বড় ছেলে নামাল দুই ভাইয়ের মধ্যে এরকম কোন দ্বন্দ্বের কথা অস্বীকার করেছেন।
নামাল রাজাপাকসে বলেন, তার বাবা মাহিন্দা রাজাপাকসে সবসময় কৃষক এবং জনগণের পক্ষে ছিলেন, অন্যদিকে গোটাভায়া রাজাপাকসে ক্ষমতাসীন দল এসএলপিপির মূল সমর্থক এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চেয়ে দোদুল্যমান ভোট টানতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন।
বহু বছর ধরে শ্রীলংকার সিংহলিদের মধ্যে রাজাপাকসেদের বিরাট জনপ্রিয়তা ছিল, যদিও তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন, সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন এবং গণমাধ্যমের ওপর মারাত্মক সব হামলার অভিযোগ ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিদের অনেকেই তখন এসব নিয়ে কথা বলেনি।
কিন্তু এখন পুরো দেশ যখন সংকটে পড়েছে, তখন জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভ সব জাতিগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। সিংহলি বিক্ষোভকারীরাও এখন সংখ্যালঘুদের অধিকারের পক্ষে কথা বলতে শুরু করেছেন।
তবে প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে ক্ষমতা ধরে রাখতে এখন যেসব কূটকৌশল নিচ্ছেন, তাতে শ্রীলংকার অনেক মানুষ তাদের ধৈর্য হারাচ্ছেন। একটি স্থিতিশীল সরকার ছাড়া শ্রীলংকার পক্ষে আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে নতুন ঋণ পাওয়া বা বিদ্যমান ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা নতুন করে নির্ধারণ করা কঠিন হবে। নতুন সরকার যদি সেটা তাড়াতাড়ি না করতে পারে, তখন আরও বেশি বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি সংকট দেখা দেবে। সূত্র: বিবিসি বাংলা