দীর্ঘকাল ধরে দেশে বোরো উৎপাদনের সিংহভাগই আসছে ‘ব্রি–২৮’ ও ‘ব্রি–২৯’ ধান থেকে। তবে দুই যুগের বেশি পুরোনো এসব জাতের উৎপাদনশীলতা দিন দিন কমছে। অন্যদিকে বাড়ছে নতুন নতুন রোগবালাইয়ের প্রকোপ।
বিকল্প হিসেবে উচ্চফলনশীল জাতের নতুন নতুন ধান চাষের চেষ্টা চলছিল অনেক দিন ধরে। এর মধ্যে সবচেয়ে আশা জাগানো নতুন জাত হিসেবে উঠে এসেছে ‘ব্রি–৮৯’ ধান। পুরোনো জাতগুলোর তুলনায় অনেক বেশি ফলন দিচ্ছে এ ধান। এই ধানের ভাত খেতে সুস্বাদু।
উচ্চফলনশীল এই জাত উদ্ভাবন করে এবার যৌথভাবে গবেষণা ক্যাটাগরিতে একুশে পদক পেয়েছেন গাজীপুরের বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) তিন কৃষি বিজ্ঞানী। তাঁরা হলেন মো. এনামুল হক (দলনেতা), সাহানাজ সুলতানা (দলগত) ও জান্নাতুল ফেরদৌস (দলগত)।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, একটি জাত উদ্ভাবনে দীর্ঘদিন সময় লাগে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১২ বছর বা কখনো ১৩ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। ব্রি–৮৯ জাতটি উদ্ভাবনে গবেষক দলটির প্রায় ১০ বছর সময় লেগেছে। এখন পর্যন্ত মাঠে উৎপাদন খুব ভালো। জাতটি ধীরে ধীরে কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
ব্রি সূত্রে জানা গেছে, ব্রি-৮৯ জাতসহ আরও পাঁচটি নতুন জাতের ধানের বিভিন্ন গুণ উল্লেখ করে এবং প্রমাণসহ গত বছরের অক্টোবরে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গঠিত একুশে পদক যাচাই–বাছাই কমিটির কাছে জমা দেওয়া হয়। পরে তারা সবকিছু যাচাই–বাছাই করে ব্রি-৮৯ জাতের জন্য ব্রির জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের প্রধান ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. এনামুল হক, ব্রির জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সাহানাজ সুলতানা ও জান্নাতুল ফেরদৌসকে নির্বাচিত করে।
ব্রি-৮৯ ধান নিয়ে যা জানার আছে
নতুন উদ্ভাবিত ব্রি–৮৯ ধান জাতে আধুনিক উচ্চফলনশীল বা উফশী ধানের সব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান জানিয়ে মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. এনামুল হক বলেন, এ জাতের ডিগ পাতা খাড়া এবং লম্বা। ধানের দানা অনেকটা ব্রি–২৯ ধানের মতো, তবে সামান্য চিকন। পূর্ণবয়স্ক গাছের গড় উচ্চতা ১০৬ সেন্টিমিটার। এ জাতের কাণ্ড শক্ত, পাতা হালকা সবুজ এবং ডিগ পাতা চওড়া। ধানের ছড়া লম্বা, পাকার সময় কাণ্ড ও পাতা সবুজ থাকে। ফলে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। এতে শিষের গোড়ার ধানও পুষ্ট হয়। এর জীবনকাল ব্রি–২৯ ধানের চেয়ে ৩ থেকে ৫ দিন আগাম। ১ হাজার পুষ্ট ধানের ওজন প্রায় ২৪ দশমিক ৪ গ্রাম। চালে অ্যামাইলেজের পরিমাণ ২৮ দশমিক ৫ ভাগ। চালের আকার–আকৃতি মাঝারি চিকন, রান্নার পর ভাত চালের ১ দশমিক ৪ গুণ লম্বা হয়। ভাত ঝরঝরে ও খেতে সুস্বাদু।
ব্রি-৮৯ ধানের চাষ–পদ্ধতি
বীজ বপনের সময় ১৭ কার্তিক থেকে ১ অগ্রহায়ণ (১ নভেম্বর-১৫ নভেম্বর)। ৪০ থেকে ৪৫ দিন বয়সী চারা ২০ বাই ২০ সেন্টিমিটার ব্যবধানে রোপণ করতে হবে। চারা রোপণের সময় ১ পৌষ-৩০ পৌষ (১৫ ডিসেম্বর-১৩ জানুয়ারি)। প্রতি গোছায় ২–৩টি করে চারা রোপণ করতে হবে। এই ধান চাষে প্রতি বিঘায় ৩৫ থেকে ৪০ কেজি ইউরিয়া, ১২ থেকে ১৪ কেজি টিএসপি, ১৫ থেকে ২০ কেজি এমওপি, ১২ থেকে ১৫ কেজি জিপসাম এবং এক থেকে দেড় কেজি দস্তা বা জিংক সালফেট সার লাগবে। রোপণের ৪০ থেকে ৪৫ দিন জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে এবং প্রয়োজনমতো সম্পূরক সেচ দিতে হবে।
ব্রির কর্মকর্তারা বলেন, এ জাতে রোগের আক্রমণ অন্যান্য জাতের তুলনায় কম। তবে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা দিলে অনুমোদিত বালাইনাশক অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। ৫ থেকে ২০ বৈশাখ বা ১৮ এপ্রিল থেকে ৩০ মের মধ্যে ফসল কাটা যাবে। এ জাতের জীবনকাল ব্রি–২৮ ধানের এর চেয়ে ৩-৪ দিন আগাম এবং ফলন বেশি। এ কারণে যেসব এলাকায় ব্রি–২৯ ধান চাষাবাদ হয়, সেখানে সহজেই ব্রি–৮৯ ধান চাষ করা যাবে। ফলন বেশি হওয়ায় কৃষক লাভবান হবেন।
সাহানাজ সুলতানা বলেন, ‘যেকোনো উদ্ভাবনই যৌথ গবেষণার ফল। এক্ষেত্রে যৌথভাবে আমরা জাতটি উদ্ভাবন করেছি।’
জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘আমাদের আগের মেগা ভ্যারাইটি ব্রি–২৯ ধানের চেয়ে উচ্চফলনশীল ধানের জাত ব্রি–৮৯ ধানের জাতটির ফলন এক টন বেশি। কোথাও কোথাও জাতটির ফলন ১০ টন পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে।’
একুশে পদকপ্রাপ্তির বিষয়ে মো. এনামুল হক বলেন, এটি একটি জাতীয় পদক। এমন সম্মানজনক একটি পদক পেয়ে তাঁরা খুবই আনন্দিত। এই অর্জন ব্রির সব বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তাসহ সবার সমন্বিত অর্জন। এটি পাওয়ার মাধ্যমে ভবিষ্যতে গবেষণার ক্ষেত্রে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ আরও বেড়ে গেল।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এর আগে স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছিল। প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক শাহজাহান মিয়া বলেন, একুশে পদক পাওয়া আনন্দের সংবাদ। এ বছর পাঁচজন কৃষিবিদ একুশে পদক পেয়েছেন। পাঁচজনের মধ্যে তিনজনই তাঁদের প্রতিষ্ঠানের। এই পুরস্কার পাওয়ায় তাঁদের সবার দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে। বিজ্ঞানীদের গবেষণায় প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সব রকমের সহযোগিতা করা হবে।