ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যে ভার্চুয়াল বৈঠক হয়েছে। এই বৈঠকে বিশ্বব্যাপী সঙ্কট, কোভিড মহামারি এবং জলবায়ু সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বৈঠকে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে বুচা গণহত্যার নিন্দা জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
বাইডেনের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকে তিনি বলেন, ‘আমি ইউক্রেন এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ফোনে একাধিকবার কথা বলেছি। আমি শুধুমাত্র তাঁদের কাছে শান্তির পক্ষে সওয়াল করিনি, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে সরাসরি আলোচনার জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে পরামর্শ দিয়েছি। আমাদের সংসদে ইউক্রেনের পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি।’
ভারত শুরু থেকে ইউক্রেন এবং রাশিয়ার যুদ্ধে ভারসাম্যের অবস্থান নিয়েছে। আমেরিকার পাশে দাঁড়িয়ে রাশিয়ার বিরোধিতা করেনি। বরং জাতিসংঘে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোটদান থেকে বিরত থেকেছে নয়াদিল্লি। প্রথম থেকেই আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছে। তবে সম্প্রতি বুচার ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে ভারত। বুচায় ইউক্রেনীয় নাগরিকদের গণহত্যার নিন্দা জানিয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি টিএস তিরুমূর্তি বলেছিলেন, ‘সম্প্রতি ইউক্রেনের বুচা শহরে মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে, যা খুবই উদ্বেগজনক। আমরা এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করছি এবং ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবিকে সমর্থন করি।’সেইসঙ্গে নিজেদের অবস্থান অনড় থেকে ভারতের প্রতিনিধি জানান, আলোচনার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ অবিলম্বে শেষ হওয়া উচিত।
সোমবার বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকে একই অবস্থান বজায় রেখে মোদী বলেন, ‘বুচায় নিরীহ মানুষকে হত্যার খবর অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আমরা সঙ্গে সঙ্গে সেই ঘটনার নিন্দা করেছি এবং নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি তুলেছি। আমাদের আশা, রাশিয়া এবং ইউক্রেনের দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে শান্তির পথ বেরিয়ে আসবে।’
দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বাৎসরিক বৈঠক ২০১৮ সাল থেকেই চালু করা হয়েছিল। যেটি ‘২+২ ডায়ালগ’নামে পরিচিত। দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক আরও গভীর করতে এই বৈঠক চালু হয়।
এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতির বর্তমান অবস্থায় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশই নিজেদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরো মজবুত করতে চায়। চীনকে সামাল দিতে এশিয়ার দেশ হিসেবে কৌশলগত করণে ভারতকে প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের। এ কারণে চীনের সামনে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাতে ভারতকে সাহায্য করতে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র।
ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশ নানা বিবৃতিতে নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক আরো দৃঢ় করার কথা বলেছে। কিন্তু এখন গোল বেঁধেছে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া। ওই যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত ভিন্ন অবস্থানে রয়েছে।
দিল্লি কড়া ভাষায় ইউক্রেনে আগ্রাসন নিয়ে মন্তব্য করলেও কখনো সরাসরি মস্কোর সমালোচনা করেনি। এছাড়া, ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জাতিসংঘে এখন পর্যন্ত রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে কয়কটি প্রস্তাবনা উত্থাপন করা হয়েছে তার সবগুলোতে ভোট দান থেকে বিরত থেকেছে ভারত।
পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার উপর যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ভারত সেগুলোও কৌশলে এড়িয়ে যেতে চাইছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় তেল বিক্রি প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া রাশিয়া ভারতকে ছাড় মূল্যে তেল কেনার প্রস্তাব দিয়েছে। ভারত ওই প্রস্তাব গ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কিন্তু একে ভাল চোখে দেখছে না যুক্তরাষ্ট্র।
নিজস্ব ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণেও ভারত তাদের জোট নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রাখতে চাইছে। কারণ, মস্কো দিল্লির পরীক্ষিত মিত্র। এছাড়া, ভারতের প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের প্রায় ৫০ শতাংশের যোগানদাতা দেশ রাশিয়া।
কিন্তু এখন ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এশিয়ার মিত্র দেশগুলোর কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন আদায়ের চেষ্টার মধ্যেই মোদীর সঙ্গে বাইডেনের এই জরুরি বৈঠক হল। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা এ বৈঠককে ঊষ্ণ এবং আন্তরিক বলেই বর্ণনা করেছেন।
একাধিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন দুই নেতা। আর এই বৈঠক থেকে বাইডেন সহ বিশ্বকে বার্তা দিয়েছেন মোদী। স্পষ্টতই জানিয়েছেন যে, তিনি একাধিকবার ইউক্রেন এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলেছেন। দুজনকেই শান্তি ফিরিয়ে আনার বার্তাও দিয়েছেন।
এমনকী পুতিনকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমেও সমস্যা সমাধানের কথাও বলেছেন বলে বাইডেনকে জানান মোদী।
একইসঙ্গে বাইডেন এবং মোদী দুইজনই বৈঠকে ইউক্রেনের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, বিশেষ করে বুচায় বেসামরিক নাগরিক হত্যা নিয়ে। বুচাতে নিরপরাধ মানুষকে যেভাবে মারা হয়েছে তা নিয়েও বার্তা দিয়ে মোদী বলেন, “বুচার ঘটনা খুবই উদ্বেগজনক। এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই।” ঘটনাটির নিরপেক্ষ তদন্তের কথাও বাইডেনকে বলেছেন তিনি।
ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে নয়াদিল্লির ‘নিরপেক্ষ অবস্থান ব্যাখ্যা’ করেছেন মোদী। তিনি আশা প্রকাশ করে এও বলেছেন, আলোচনার মাধ্যমেই রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধের একটা দিক নিশ্চয় বেরিয়ে আসবে। একই সঙ্গে তিনি বলেন, যে কোনও পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের পাশে আছে ভারত।
অন্যদিকে, রাশিয়া এবং ইউক্রেন ছাড়াও এদিন দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নসহ ইন্দো-প্যাসিফিক পরিস্থিতি, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সহ একাধিক ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে বাইডেন এবং মোদীর মধ্যে।
ভারত-আমেরিকা টু প্লাস টু বৈঠকের পরই ভারতীয় প্রতিনিধিদের অস্বস্তিতে ফেললেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলে দিলেন, “ভারতের ক্রমবর্ধমান মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলির দিকে নজর রয়েছে আমেরিকার।”
সোমবার মার্কিন প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর। টু প্লাস টু বৈঠকের পরেই যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন বলেন,”ভারতে কিছু সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ এবং জেল কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ উঠছে। সেদিকে আমেরিকার নজর রয়েছে। আমরা নিয়মিত এ বিষয়ে আমাদের ভারতীয় বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি।” যদিও ঠিক কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি একথা বলছেন, সেটা স্পষ্ট করেননি ব্লিঙ্কেন।
ব্লিঙ্কেন যে সাংবাদিক বৈঠকে এই কথাগুলি বলেন তাতে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনও উপস্থিত ছিলেন। ভারতের তরফে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংও। ভারতের দুই মন্ত্রীর সামনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারতে মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুললেও রাজনাথ বা জয়শংকর নিজেদের ভাষণে এই বক্তব্যের কোনও জবাব দেননি। ভারতের প্রথম সারির দুই মন্ত্রী নিজেদের ভাষণে মানবাধিকার প্রসঙ্গটি পুরোপুরি এড়িয়ে গিয়েছেন।
গত সপ্তাহেই বাইডেনের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্য ইলহান ওমর ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘটা একাধিক ঘটনার সমালোচনায় সরব হন। তিনি বলেন, “ভারতের মুসলমান জনসংখ্যার জন্য মোদী এমন কী করেছেন, যার জন্য আমরা ভারতকে দুনিয়া জুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার অভিযানে আমেরিকার সঙ্গী ভাবতে পারি?” ইলহানের মন্তব্যের পর ব্লিঙ্কেনের সোমবারের বক্তব্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
রাশিয়া থেকে অশোধিত তেল কেনা নিয়ে প্রথম থেকেই ভারতের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছে আমেরিকা। এমনকী নিজেদের প্রতিনিধি পাঠিয়েও ভারতের বিরুদ্ধে রীতিমতো হুঁশিয়ারি দিয়েছিল মার্কিন প্রশাসন। সেই বক্তব্যের প্রেক্ষিতেই মুখ খুলেছেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শংক। তিনি জানিয়েছেন, ভারতকে সতর্ক করার আগে আমেরিকার উচিত ইউরোপের মার্কিন ঘনিষ্ঠ দেশগুলির দিকে নজর দেওয়া।
সোমবার ওয়াশিংটনে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনা হয়। মার্কিন প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর। বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন তাঁরা। সেই সময় মার্কিন বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে প্রশ্ন করা হয় যে রুশ এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম কেনার জন্য ভারতের উপর কি নিষেধাজ্ঞা জারি করবে আমেরিকা? উত্তরে ব্লিঙ্কেন বলেন, “রাশিয়া ইউক্রেনে যা করছে সেই কথা মাথায় রেখে আমি সব দেশের কাছে আরজি জানাচ্ছি তারা যেন রাশিয়া থেকে অস্ত্র না কেনে। এখনও CAATSA আইনে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি হবে না ছাড় দেওয়া হবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।”