বৃত্তান্ত ডেস্ক: টানা চার দিন ট্যুরিস্ট পুলিশের হেফাজতে ‘বন্দিদশা’ থেকে মুক্তি পেয়ে অনেকটা গোপনে ঢাকার যাত্রাবাড়ীর বাসায় ফিরেছেন কক্সবাজারে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার নারী ও তাঁর স্বামী-সন্তান। গতকাল রোববার রাতে তাঁরা ঢাকায় পৌঁছান।
সোমবার সকালে মামলার বাদী ওই নারীর স্বামী বলেন, পুলিশের তদন্তে তাঁর আস্থা নেই। দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার যেন সুষ্ঠু তদন্ত হয়, তার জন্য তাঁরা বিচার বিভাগীয় তদন্ত চান। এ ব্যাপারে তাঁরা শিগগিরই ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে ওই দিনের ঘটনার সবকিছু প্রকাশ করবেন।
মামলার বাদী প্রথম আলোকে বলেন, এ কয়েক দিন নানা চাপের মধ্যে তাঁর স্ত্রীকে উল্টাপাল্টা বক্তব্য দিতে হয়েছে। জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে কক্সবাজার আদালতে মিথ্যা জবানবন্দিও দিতে হয়েছে।
ভুক্তভোগী নারী বলেন, ২৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কক্সবাজার থানার সামনে তাঁর স্বামীকে হাতে লেখা একটি চিঠি ধরিয়ে দেন অপরিচিত কয়েকজন যুবক। তখন বলা হয়েছিল এভাবেই (চিঠিতে লেখা কথা অনুযায়ী) কথা বলতে হবে। নয়তো কারও প্রাণ থাকবে না। এরপর তিনি স্বামী-সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে শেখানো বুলিতে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। এই জবানবন্দি দিতে তখন স্বামীও তাঁকে চাপ দেন।
ওই নারী বলেন, সত্য হলো সন্ত্রাসী আশিকের সঙ্গে তাঁর পূর্বপরিচয় ছিল না। আশিকের নেতৃত্বে প্রথমে ঝুপড়ির চায়ের দোকানে এবং পরবর্তী সময়ে হোটেল জিয়া গেস্ট ইনে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণ করেন কয়েকজন। এ সময় আশিকসহ অন্যরা তাঁকে বর্বর নির্যাতন ও মারধর করেন। ধর্ষণের এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চান ভুক্তভোগী নারী, যেন সৈকত ভ্রমণে এসে অন্য কারও এই পরিণতি না হয়।
ওই নারীর স্বামী বলেন, রোববার রাতে তাঁরা তিনজন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গ্রিনলাইন পরিবহনে চড়ে ঢাকায় পৌঁছান। টিকিট করে দিয়েছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। কক্সবাজার থানায় মামলা করার পর ২৩ ডিসেম্বর থেকে টানা চার দিন তাঁরা ট্যুরিস্ট পুলিশের হেফাজতে ‘বন্দী’ ছিলেন। এ সময় কারও সঙ্গে তাঁদের কথা বলতে দেওয়া হয়নি। খাবারদাবার ঠিকমতো দেওয়া হলেও এই চার দিনে কারও একবার গোসল হয়নি। তাই তাঁরা যেভাবে হোক কথাবার্তা বলে কক্সবাজার ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। এখন ঢাকায় পৌঁছেছেন, সবকিছু প্রকাশ করবেন।
তিনি বলেন, প্রকৃত ঘটনা থানার দায়ের করা মামলাতেই লিপিবদ্ধ আছে। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে কল দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একবার নয়, তিন দফায় তিনি ৯৯৯-এ কল দিলেও সহযোগিতা পাননি। পরে তিনি র্যাবকে কল দেন। র্যাবই ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাঁদের উদ্ধার করে।
২৩ ডিসেম্বর রাতে ধর্ষণের শিকার নারীর স্বামী বাদী হয়ে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় সন্ত্রাসী মো. আশিক (২৮), মো. বাবু (২৫), ইসরাফিল হুদা ওরফে জয় (২৮), রিয়াজ উদ্দিন ওরফে ছোটন (৩০) এবং অজ্ঞাতনামা আরও তিনজনসহ সাতজনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, ২২ ডিসেম্বর বিকেলে স্বামী ও ৮ মাসের শিশুসন্তানকে নিয়ে সৈকতের লাবণী পয়েন্টে নামেন ওই নারী। বালুচর দিয়ে হেঁটে পানির দিকে নামার সময় তাঁর স্বামীর সঙ্গে সামান্য ধাক্কা লাগে আশিকের। এর জের ধরে সন্ধ্যায় পর্যটন গলফ মাঠ এলাকা থেকে ওই নারীকে তুলে নিয়ে প্রথমে ঝুপড়ির একটি চায়ের দোকানে এবং পরে কলাতলীর একটি হোটেলে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণ করেন আশিকের নেতৃত্বে কয়েকজন।
গতকাল রাতে মাদারীপুর থেকে র্যাব মামলার প্রধান আসামি আশিককে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁর বাড়ি কক্সবাজার শহরের মধ্যম বাহারছড়া এলাকায়। এ প্রসঙ্গে র্যাব-১৫ কক্সবাজার ক্যাম্প অধিনায়ক মেজর মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, আশিককে ঢাকা থেকে কক্সবাজার আনা হচ্ছে। পরে আশিককে ট্যুরিস্ট পুলিশের মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করা হবে।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মহিউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আজ বেলা আড়াইটা পর্যন্ত সময়ে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার আশিককে ট্যুরিস্ট পুলিশের হাতে হস্তান্তর করা হয়নি। মামলার বাদী ও ধর্ষণের শিকার নারী রোববার রাতের বাসে ঢাকায় ফিরে গেছেন। গতকাল এই দলবদ্ধ ধর্ষণ মামলায় গ্রেপ্তার তিনজনকে আজ দুপুরে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে পাঁচ দিন করে রিমান্ডের আবেদন করা হবে। মামলার অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
ধর্ষণের শিকার নারী ও মামলার বাদীর বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, ‘এটা তাঁরা চাইতে পারেন। আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে তদন্তের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের তদন্তের বিন্দুমাত্র ভুল থাকবে না।’
৫০ হাজার টাকা চাঁদা না পেয়ে কক্সবাজারে দলবদ্ধ ধর্ষণ
হৃদ্রোগে আক্রান্ত আট মাসের শিশুর চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন ১০ লাখ টাকা। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাতে স্বামী-সন্তানসহ পর্যটন নগরী কক্সবাজারে যান ওই নারী। পর্যটকদের কাছ থেকে অর্থ জোগানোর বিষয়টি জেনে তাঁদের কাছে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন গ্রেপ্তার আশিক ও তাঁর সহযোগীরা। এ অর্থ না দেওয়ায় ধর্ষণের শিকার হন ওই নারী।
আজ সোমবার বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ২২ ডিসেম্বর রাতে কক্সবাজারে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ওই নারীর স্বামী বাদী হয়ে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় মামলা করেন।
র্যাব বলছে, চাঁদার টাকা না পেয়ে ওই নারীকে সুগন্ধা সৈকত থেকে জিম্মি করে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে নেওয়া হয় একটি চায়ের দোকানে। সেখান থেকে জিয়া গেস্ট ইন হোটেলে নিয়ে সৈকত এলাকার আশিকসহ অপরাধী চক্রের সদস্যরা ধর্ষণ করেন।
কক্সবাজারে নারীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় প্রধান আসামি আশিককে মাদারীপুর থেকে গতকাল রোববার রাতে গ্রেপ্তার করা হয় বলে র্যাব প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, ওই নারী আশিকের পূর্বপরিচিত ছিলেন না। ঘটনার এক দিন আগে সৈকতে তাঁদের পরিচয় হয়। সন্তানের চিকিৎসার জন্য পর্যটকদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে আশিকদের নজরে পড়েন ওই নারী।
সংবাদ সম্মেলনে খন্দকার আল মঈন বলেন, নারীকে অপহরণের পর তাঁর স্বামী র্যাব–১৫–এর কাছে উদ্ধারে সহায়তা চান। র্যাব তাঁর স্বামীকে নিয়ে ভুক্তভোগী নারীকে উদ্ধারে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায়। একপর্যায়ে ওই নারীকে উদ্ধার করা হয়। পরে ২৩ ডিসেম্বর রাতে জিম্মি করার সহযোগিতার অভিযোগে জিয়া গেস্ট ইন হোটেলের ব্যবস্থাপক রিয়াজ উদ্দিন ছোটনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
র্যাব জানায়, সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষণ করে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৮ ও ১৫–এর অভিযানে গতকাল রাতে মাদারীপুরের মোস্তাফাপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অভিযান চালিয়ে মামলার প্রধান আসামি আশিকুল ইসলামকে (২৯) গ্রেপ্তার করা হয়।
কমান্ডার মঈন বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আশিক র্যাবের কাছে ধর্ষণের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। আশিক কক্সবাজারে পর্যটন এলাকায় একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র চালান। এ চক্রের সদস্যসংখ্যা ৩০ থেকে ৩৫। ২০১২ সাল থেকে কক্সবাজার পর্যটন এলাকায় বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত আশিক। তিনি প্রথম ২০১৪ সালে অস্ত্রসহ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। র্যাব আরও জানায়, ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আড়াই বছর কারাগারে ছিলেন আশিক। তাঁর নামে কক্সবাজার সদর থানায় অস্ত্র, মাদক, নারী নির্যাতন, চাঁদাবাজিসহ ১৭টি মামলা আছে। পাঁচবার পুলিশ আশিককে গ্রেপ্তার করেছে। আশিকের নেতৃত্বে চক্রটি পর্যটন এলাকা কক্সবাজারে চুরি, ছিনতাই, অপহরণ, জিম্মি, চাঁদাবাজি, জবরদখল, ডাকাতি, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত। আশিক বিভিন্ন হোটেলে ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে যোগসাজশে পর্যটকদের বিভিন্নভাবে ফাঁদে ফেলে ব্ল্যাকমেল করতেন। এক পুলিশ সদস্যকেও ফাঁদে ফেলে ব্ল্যাকমেল করেন তিনি। (সূত্র-প্রথম আলো)।