প্রকৃতির বৈরিতার কাছে হার না মানা খেটে খাওয়া মানুষরা যেন প্রতিনিয়ত হেরে যায় অনিয়মের কাছে। বেতন বৈষম্য আর নির্যাতন সঙ্গী করে গল্প লিখেন সভ্যতার। যাদের ৯০ শতাংশই নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয়। ৮০ শতাংশকে সুরক্ষা দিতে পারে না দেশের প্রচলিত আইন।
শ্রমিকদের কি আলাদা কোনো দিবস হয়? তারা কি দেয়ালপঞ্জিকার খোঁজ রাখেন? এই যেমন আজ বৈশাখের কত তারিখ? তাপমাত্রা কত? বৃষ্টি নামবে কি না? বা বসন্ত আর কতদূর?
হয়তো রাখেন কিংবা স্বেচ্ছায় ভুলে থাকেন। তবে তালতলার ষাটোর্ধ সেতারা বেগম টানা তাপপ্রবাহেও কাজে আসতে ভুলেন না। কারণ স্বামী বিয়োগের পর ডাল চালের দায়িত্বটা যে তার কাঁধে।
সেতারা বেগম বলেন, ‘এ জায়গায় আমাদের প্রতিদিনি ৩০০ টাকা দেয়। ২০ টাকার নাস্তা খাওয়ায়। অনেকে বয়স্ক ভাতা পায়, বিধবা কার্ড এ বিভিন্ন জিনিস পায়। আমি কিছু পাই না।’
আর মুন্সিখোলার ইটভাঙা শ্রমিক তাসলিমা যেন আরও অসহায়। শারীরিক সীমাবদ্ধতা থাকায় পায়ের সাহায্যে চালান হাতের কাজ। যার কাছে ন্যায্য হিস্যার চেয়ে কাজ হারানোর ভয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
তাসলিমা বলেন, ‘প্রতিদিন ১০০ ইট ভাঙি। এই ১০০ ইটের দাম ১২০ টাকা। এই টাকা দিয়ে আমি কি ঘর ভাড়া দেবো? না কি পানির বিল দেবো না কি মেয়ের লেখাপড়া করার বেতন দেবো?’
দেশের রপ্তানির শক্তিঘর বলা হয় যে খাতকে, সে পোশাকখাতের শ্রমিকরাই যেন সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার। তাতে ২০২৩ এ ১৭১টি শ্রমিক আন্দোলনের ১১০টি ই হয় এ খাতে। আর শ্রমিকদের অসন্তোষের সবচেয়ে বড় কারণ ছিল বকেয়া বেতন আদায় ও বেতন বৃদ্ধি নিয়ে। বছর শেষে ন্যূনতম মজুরি ঠিক করে দেওয়া হলেও অনেক পোশাক শ্রমিকের ভাগে এখনও মেলেনি সেটি।
একজন পোশাক শ্রমিক বলেন, ‘এতো কম বেতনে আসলে চলে না। মাত্র ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা দেয়। অনেকবার মালিকের কাছে গিয়েছি। অনেক কান্নাকাটি করেছি। গত চারমাস হলে ঠিকমতো বেতন দেয় না। চারভাগের এক ভাগ দেয়। সময়মতো টাকা দিলে লাভ হতো। ছেলেমেয়ে নিয়ে ভালো থাকতে পারতাম একটু।’
বেতন বৈষম্য ছাড়াও চরম নিরাপত্তাহীনতা সঙ্গী করে কাজ করছেন বেশিরভাগ শ্রমিক। গত বছরে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৪৮৯ জন শ্রমিক। যেখানেও এগিয়ে পোশাক খাত। একইসময় নিহতের সংখ্যা ৭৪২ জন। নিহত সংখ্যায় এগিয়ে পরিবহন, নির্মাণ ও কৃষিখাতে।
কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের স্বীকার হয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও কম নয়। যেখানে রিকশা শ্রমিক, নিরাপত্তা ও গৃহকর্মীরা বেশি ভুক্তভোগী।
বেতন বৈষম্য, নির্যাতন ও নায্য অধিকার আদায়ের এসব সংবাদ যে গণমাধ্যম প্রতিনিয়ত তুলে ধরে, তারা কি এড়াতে পেরেছে অনিয়ম? সংবাদকর্মীরা কতটা পাচ্ছে নায্য অধিকার?
সংবাদকর্মী আলিমুজ্জামান বলেন, ‘৮০ বা ৯০ এর দশকে এগুলো আমরা কখনও দেখিনি। ২০০০ সাল থেকে লক্ষ্য করলাম বাসস ছাড়া কোনো বোর্ডের ইমপ্লিমেন্টেশন করেনি। এটা একটা বিশাল বৈষম্য।’
শ্রম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন ৮০ শতাংশ শ্রমিককেই সুরক্ষা দিতে পারে না। অধিকার নিশ্চিতে আগে প্রয়োজন আইন সংশোধন।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এই শ্রম আইন মাত্র ২০ ভাগ শ্রমিককে সুরক্ষা দেয়। আর ৮০ ভাগ শ্রমিক এরমধ্যেই নেই। এবং এই ৮০ ভাগের মধ্যে একদম শিক্ষিত যুব শেণি আছে যাবা বিভিন্ন ব্যাংক বীমা ও বিভিন্ন আইটি সেক্টরে কাজ করে।’
অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে একটা দেশের এগিয়ে চরা দৃশ্যমান হয়। আর এ উন্নয়নের সবচেয়ে বড় অংশীদার দেশের নানা পেশার শ্রমিকরা। তবে বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ শ্রমিক কাজ করেন অপ্রতিষ্ঠানিক খাতে। যাদের নেই নির্দিষ্ট বেতন,কর্মঘণ্টা, ভাতা কিংবা ছুটির মতো বিষয়গুলো।