ঢাকের বাদ্যের সঙ্গে উলুধ্বনি, শঙ্খনাদ আর কাসর ঘণ্টা বাজিয়ে ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হল।
ঢাকা মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কিশোর রঞ্জন মণ্ডল জানান, সোমবার সকাল ৯টায় দেবীর ষষ্ঠাদি কল্পারম্ভে ষষ্ঠী পূজা শুরু হয়েছে।
ষষ্ঠী তিথিতে বেলতলায় বিহিতপূজার পর দেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে হয়েছে মূল দুর্গোৎসবের সূচনা।
“বিকালে সারা দেশে মণ্ডপে মণ্ডপে হবে দেবীর ঘুম ভাঙানোর বন্দনা পূজা বা বোধন। তারপর মাকে পূজা দিয়ে বরণ করে আমরা মন্দিরে যাব।“
হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, দশভূজা দেবী দুর্গা অসুর বধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতি শরতে কৈলাস ছেড়ে কন্যারূপে মর্ত্যলোকে আসেন। সন্তানদের নিয়ে পক্ষকাল পিতার গৃহে কাটিয়ে আবার ফিরে যান দেবালয়ে। আশ্বিন শুক্লপক্ষের এই ১৫টি দিন দেবীপক্ষ, মর্ত্যলোকে উৎসব।
বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মতে শুক্রবার বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে এবারের দুর্গোৎসবের শেষ হবে। একটি বছরের জন্য ‘দুর্গতিনাশিনী’ দেবী ফিরে যাবেন কৈলাসে দেবালয়ে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, ত্রেতাযুগে ভগবান রাম তার স্ত্রী সীতাকে উদ্ধার করতে দেবী দুর্গার অকালবোধন করেন। ব্রহ্মার নির্দেশ অনুযায়ী দুর্গার সাহায্যে রাবণ বধ করে সীতাকে উদ্ধার করেন তিনি। দেবীর সেই আগমণের সময়ই দুর্গোৎসব।
রাম শরৎকালে দেবীকে আহ্বান করেছিলেন বলে এ পূজা শারদীয় দুর্গা পূজা নামেও পরিচিত। আর মর্ত্যলোকে আসতে দেবীর সেই ঘুম ভাঙানোকে বলা বলা হয় অকাল বোধন।
শাস্ত্র বলছে, “রবৌ সোমে গজরূঢ়া, ঘোটকে শনি ভৌময়ৌঃ৷ দোলায়ঞ্চ গুরৌ শুক্রে, নৌকায়ং বুধবাসরে৷”
উৎসবের রঙ মণ্ডপে মণ্ডপে
অর্থাৎ, দুর্গার গমনাগমন যদি রবি বা সোমবার হয়, তাহলে তার বাহন হয় গজ বা হাতি ৷ আবার শনি বা মঙ্গলবার হলে তিনি চড়েন ঘোটকে বা ঘোড়ায় ৷
কিন্তু বৃহস্পতি বা শুক্রবার যদি দুর্গার গমনাগমন ঘটে তাহলে তিনি দোলায় বা পালকিতে যাতায়াত করেন ৷ আর সেটা বুধবার হলে তার বাহন হয় নৌকা ৷
এবার সপ্তমী মঙ্গলবার হওয়ায় হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী দুর্গা এবার আসবেন ঘোড়ায় চড়ে। আর শুক্রবার দশমীতে কৈলাসে দেবালয়ে ফিরবেন দোলায় চেপে।
দেবীর ঘোড়ায় চেপে আগমন নিয়ে শাস্ত্রে বলা হয়েছে: ‘ছত্রভঙ্গস্তুরঙ্গমে’। অর্থাৎ, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংসারিক ক্ষেত্রে ঘটবে অস্থিরতা। বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, দুর্ঘটনা ও অপমৃত্যু বাড়বে।
আর দোলায় চেপে দেবীর বিদায়ের ফল নিয়ে শাস্ত্র বলছে: ‘দোলায়াং মরকং ভবেৎ’। অর্থাৎ, মহামারী, ভূমিকম্প, যুদ্ধ, মন্বন্তর, খরার প্রভাব দেখে দিবে, সঙ্গী হবে মৃত্যু আর ক্ষতি।
কিশোর রঞ্জন মণ্ডল জানান, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি বিবেচনায় মণ্ডপে দর্শনার্থীদের জন্য মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ বছর পূজায় কোনো আরতি প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক আয়োজন কিংবা মন্দিরের আশেপাশে মেলা থাকছে না। মন্দিরের প্রবেশ পথে নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা লাইন রাখা হচ্ছে।
এবার দেশজুড়ে ৩২ হাজার ১১৭ মণ্ডপে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে; গত বছরের তুলনায় এক হাজার ৯০৫টি মণ্ডপ বেড়েছে। ঢাকায় এ বছর দুর্গ পূজা হবে ২৩৮টি মণ্ডপে।
দুর্গাপূজা ঘিরে ‘কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা’ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম।
রোববার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পরিদর্শন করে তিনি মহামারীর এই সময়ে ভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে স্বাস্থ্যবিধি মানার উপর জোর দেন।
অনুষ্ঠান সূচি
মহাসপ্তমী (মঙ্গলবার): সকাল ৮টা ৫৯ মিনিটের মধ্যে শ্রী শ্রী দুর্গাদেবীর নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্থাপন, সপ্তমাদি কল্পারম্ভ ও মহাসপ্তমী বিহিত পূজা।
মহাঅষ্টমী (বুধবার): সকাল ৮টা ৫৯ মিনিটের দুর্গাদেবীর অষ্টমাদি কল্পারম্ভ ও বিহিত পূজা। রাত ১১টা ৫৪ মিনিটে সন্ধি পূজা আরম্ভ ও সমাপনী রাত ১২টা ৪২ মিনিটে। মধ্যাহ্ণ মহাপ্রসাদ বিতরণ।
মহানবমী (বৃহস্পতিবার): সকাল ৯টা ৫৭ মিনিটের মধ্যে দুর্গাদেবীর মহানবমী কল্পারম্ভ ও মহানবমী বিহিত পূজা।
বিজয়া দশমী (শুক্রবার): সকাল ৯টা ১১ মিনিটের মধ্যে দুর্গাদেবীর দশী বিহিতপূজা ও পূজান্তে দর্পন বিসর্জন।