২০১৪ সালে ক্ষমতায় বসেই নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’। অর্থাৎ, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করাই তাঁর মূলনীতি। আজ ১০ বছর পর দেখা যাচ্ছে, ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশীদের সম্পর্কের উন্নতির চেয়ে অবনতিই হয়েছে বেশি। আর সবচেয়ে বেশি অবনতি হয়েছে সম্ভবত এই চব্বিশেই।
ভারতের সঙ্গে স্থলসীমান্ত রয়েছে সাতটি দেশের–নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, চীন ও বাংলাদেশের। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের সঙ্গে রয়েছে সমুদ্রসীমান্ত। অর্থাৎ, এক লাইনে বলা যায়, মোট নয়টি প্রতিবেশী দেশ রয়েছে ভারতের।
নরেন্দ্র মোদি প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসার আগে ২০১৪ সালে তাঁর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এই নয়টি দেশেরই রাষ্ট্রপ্রধানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এমনকি চিরবৈরী পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে পর্যন্ত আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ধারণা করা হয়েছিল, প্রতিবেশী যেসব দেশের সঙ্গে টুকটাক বৈরিতা রয়েছে ভারতের, তা এই দফায় ঘুচবে হয়তো। কিন্তু দিন যত গড়িয়েছে, তার উল্টো ঘটনাই ঘটেছে বেশি।
এ বছরের এপ্রিলে নেপালে অর্থনৈতিক অবরোধ চলছিল ভারতেরই প্রচ্ছন্ন সমর্থনে। তাই নেপালের সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে ভারতবিরোধী বিক্ষোভ করেছে। এখনো সে দেশে ভারতবিরোধিতা তুঙ্গে। সহসা নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের উন্নতি হবে, তা বলা যাচ্ছে না।
এরপর সামরিক, বৈদেশিক ও অর্থনৈতিক থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে ভারতের ওপর নির্ভরশীল একটি দেশ ভুটান। এমনকি ২০০৭ সাল পর্যন্ত ভুটানের বিদেশনীতি পর্যন্ত পুরোপুরি দেখভাল করত ভারত। ২০০৭ সালে চুক্তি নবায়নের পর কিছুটা স্বাধীনতা পেয়েছে ভুটান। সেই ভুটানও এখন চীনের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে আলোচনা করতে চাচ্ছে। চলতি বছরের এপ্রিলে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং বলেছিলেন, চীনের সঙ্গে ভুটানের সীমান্ত সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যেতে পারে। অর্থাৎ, ভুটান ও ভারতের মাঝে যে ‘দোকলাম’ নিয়ে ঝামেলা রয়েছে, সেটি চীনের কাছে ছেড়ে দিলেই সীমান্ত সমস্যা মিটে যায়। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী মূলত দোকলামকে চীনের কাছে ছেড়ে দেওয়ারই ইঙ্গিত দিয়েছেন। এ ছাড়া কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে চীনের প্রস্তাবকেও সরাসরি নাকচ করেনি দেশটি। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ভারতের হাত গলে বেরিয়ে যাচ্ছে ভুটান।
আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের সঙ্গেও সম্পর্ক খুব একটা সুবিধাজনক নয় ভারতের। তালেবান সরকারকে এখন পর্যন্ত স্বীকৃতিই দেয়নি ভারত। তালেবান সরকার ভারতের জন্য সরাসরি বিপজ্জনক না হলেও পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বা ও জয়শ-ই-মুহাম্মদের সঙ্গে আফগানিস্তানের সংযোগ রয়েছে, যা ভারতের জন্য উদ্বেগের। কিন্তু এই উদ্বেগ নিরসনে মোদি সরকার ২০২৪ সালেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
মিয়ানমারে এখন গৃহযুদ্ধ তুঙ্গে। ভারত সমর্থিত জান্তা সরকারের কাছ থেকে এরই মধ্যে বহু এলাকা দখল করে নিয়েছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। এর মধ্যে ভারতের মণিপুর রাজ্যঘেঁষা মিয়ানমারের ‘চিন’ রাজ্যও রয়েছে। অর্থাৎ, ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যও দখলে নিয়েছে মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা। প্রতিবেশী এই দেশে ভারত কোটি কোটি অর্থ বিনিয়োগ করে রেখেছে। সবই এ বছর প্রবল অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ল।
মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত রয়েছে অরুণাচল, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম ও মণিপুর রাজ্যের। মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এতটাই খারাপ হয়েছে যে, এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে এই চার রাজ্যের সামান্তজুড়েই কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার ঘোষণা দেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তাঁর দাবি, মিয়ানমার থেকে প্রচুর আফিমচাষী মণিপুরে অনুপ্রবেশ করেছে এবং তারাই মণিপুরের জাতিগত সহিংসতা উসকে দিচ্ছে।
আর চীনের সঙ্গেও ভারতের দ্বন্দ্ব তো বহু পুরোনো। মূলত তিব্বত সীমান্ত নিয়েই এই দ্বন্দ্ব। এ ছাড়া তিব্বতের নেতা দালাই লামাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়া নিয়েও অস্বস্তি রয়েছে চীনের।
ভারত দাবি করে, চীনের সাথে থাকা সীমান্ত ঘেঁষে তাদের প্রায় সাড়ে তিন হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা চীনের ভেতরে ঢুকে গেছে। চীনের উচিত সেগুলো ফেরত দেওয়া। অন্যদিকে চীন পাল্টা দাবি করে, তাদের অন্তত দুই হাজার বর্গকিলোমিটার সীমান্ত এলাকা ভারতের ভেতরে রয়েছে।
ভারত ও চীনের সীমান্ত শুরু হয়েছে মূলত ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় লাদাখ থেকে এবং শেষ হয়েছে অরুণাচল প্রদেশে। চীন এই বিশাল অংশকে বলে দক্ষিণ তিব্বত।
তিব্বত নিয়ে চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের উন্নতি এই ২০২৪ সালেও দেখা যায়নি। বরং এ বছরের অক্টোবরে পূর্ব লাদাখে ভারত ও চীনের সেনারা মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছিল। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল ভারত-চীন সীমান্তে। পরে অবশ্য দুই দেশই সীমান্ত থেকে সেনা সরিয়ে নেয়।
আর পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। চিরবৈরী এই দেশের সঙ্গে কখনোই সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়নি ভারতের। মূলত ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভেঙে পাকিস্তান ও ভারত নামের দুটি দেশ সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই দুটি দেশের বৈরিতার শুরু। সেটি এখনো চলমান। ১৯৪৭ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত চারবার যুদ্ধে জড়িয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। চারটি যুদ্ধই হয়েছে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে।
এ বছর মালদ্বীপের ক্ষমতায় বসেছেন মুহাম্মদ মুইজ্জু। তাঁর নির্বাচনী স্লোগানই ছিল–‘ইন্ডিয়া আউট’। তিনি প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসার পরপরই ভারতকে অনুরোধ করেন মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার। ভারত বাধ্য হয়ে সেনা প্রত্যাহার করে। এ ছাড়া মালদ্বীপের প্রথা ছিল, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথম সফরে ভারত যাওয়া। কিন্তু মুইজ্জু দীর্ঘদিনের সেই প্রথাটিও ভেঙেছেন। তিনি প্রধামন্ত্রী হওয়ার পর প্রথম তুরস্ক সফরে গেছেন। এরপর তিনি চীন সফরে যান। প্রবলভাবে চীনপন্থী মুইজ্জুর সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের যে উন্নতি হবে না, তা হলফ করেই বলা যায়।
দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় এতদিন রাজাপক্ষে সরকারকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে এসেছে ভারত। কিন্তু সেখানেও ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসেছেন বামপন্থী অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েক। তাঁর রাজনীতির পাঠ শুরু হয়েছিল চীনা বিপ্লব দিয়ে। দিশানায়েক চীনের ঘনিষ্ঠ হিসেবেই পরিচিত। ফলে শ্রীলঙ্কায় এখন ভারতের বদলে চীনের প্রভাব বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। বলার অপেক্ষা রাখে না, শ্রীলঙ্কাও ভারতের হাত ফসকে বের হয়ে গেল এই দফায়। মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, তামিল সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। আর দিশানায়েক তো আগেই বলে দিয়েছেন, তিনি শ্রীলঙ্কায় গৌতম আদানির বায়ুশক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রকল্প পুনর্বিবেচনা করবেন। কারণ, তা শ্রীলঙ্কার ‘জ্বালানি সার্বভৌমত্বের’ বিরোধী। এই প্রকল্পের আকার কম নয়, ১০ বিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে যা বোঝা যাচ্ছে, রনিল বিক্রমাসিংহের সময় ২০২৩ সালে শ্রীলঙ্কা আর ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘ইকোনমিক পার্টনারশিপ ভিশন’-এর ভবিষ্যৎ এখন পুরোটাই অনিশ্চিত।
সবশেষে বলা যায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশের সঙ্গেই ভারতের সম্পর্ক স্থিতিশীল ছিল। কিন্ত গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান ও সরকার ব্যবস্থায় পটপরিবর্তনের ফলে ঢাকার সঙ্গেও দিল্লির সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। এরই মধ্যে ভারত সরকার বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা দেওয়া সীমিত করে দিয়েছে। ফলে চিকিৎসা, বিনোদন, পর্যটন ও ব্যবসা-বাণিজ্য অনেকাংশে ব্যহত হয়ে পড়েছে। ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশি দূতাবাসে হামলার ঘটনাও ঘটেছে। এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাংলাদেশ।
সবমিলিয়ে বিশ্লেষকেরা এখন বলছেন, ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতেই কি এমন কিছু গুরুতর ত্রুটিবিচ্যুতি ঘটেছে, যার কারণে একের পর এক প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে? তথূসূত্র: দ্য হিন্দু, ইন্ডিয়া টুডে, বিবিসি, এএফপি ও ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট