বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ০১:০০ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম :
আরও ১৪ সাংবাদিকের ব্যাংক হিসাব তলব দেশের বাজারে আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম পুতুল, টিউলিপসহ সাতজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ৪ বছর করার সুপারিশ ‘দুইবারের বেশি একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না’ সংস্কার প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই নির্বাচন: প্রধান উপদেষ্টা মালয়েশিয়ার হাইকমিশনারের সঙ্গে জামায়াত আমিরের সৌজন্য সাক্ষাৎ আইনশৃঙ্খলা বা‌হিনীর যারা বাড়াবাড়ি করেছে তাদের ধরা হচ্ছে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নেতৃত্বদানে অগ্নিপরীক্ষার সামনে ডোনাল্ড ট্রাম্প উইজডেনের বর্ষসেরা ওয়ানডে একাদশে তাসকিন বদলি তারকার গোলে লিভারপুলের ড্র দুই গোলে এগিয়ে থেকেও জয়হীন ম্যানসিটি ছাগলকাণ্ডে জড়িত মতিউর ও তার স্ত্রী গ্রেপ্তার ‘ডেসটিনির এমডি রফিকুলের মুক্তিতে বাঁধা থাকছে না’ অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেকসহ সব আসামি খালাস

রোহিঙ্গা শিবিরে সহিংসতার নেপথ্যে ৪ কারণ

রিপোর্টারের নাম :
আপডেট : অক্টোবর ২৪, ২০২১

কক্সবাজার প্রতিনিধি: কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর অভ্যন্তরে প্রায় ৩০০ মাদ্রাসা রয়েছে। রোহিঙ্গাদের দুটি সংগঠন—উলামা কাউন্সিল ও ইসলামি মাহাস এসব মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তবে এই নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। মূলত চারটি কারণে এই বিরোধ তুঙ্গে ওঠায় রক্তক্ষয়ী হামলার ঘটনা ঘটে বলে মনে করছেন রোহিঙ্গা নেতারা। যে হামলায় ছয় রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। যাঁদের মধ্যে রোহিঙ্গা মাদ্রাসাশিক্ষক ও স্বেচ্ছাসেবকেরা আছেন।

রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উখিয়ার থাইনখালী (ক্যাম্প-১৮) আশ্রয়শিবিরের মসজিদ-মাদ্রাসায় হামলায় অংশ নিয়েছিল তিনটি পৃথক গ্রুপে অন্তত ২৫০ জন রোহিঙ্গা। হামলায় অংশ নেওয়া অধিকাংশই মিয়ানমারের সশস্ত্র গ্রুপ ‘আরাকান স্যালভেশন আর্মি-আরসা’ (আল-ইয়াকিন নামেও পরিচিত) এবং আরসার শাখা সংগঠন ‘উলামা কাউন্সিলের’ সদস্য।

হামলার নেপথ্যে চার কারণ

সশস্ত্র হামলার প্রধান কারণ হিসেবে রোহিঙ্গা নেতারা মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চলা দ্বন্দ্বকে দায়ী করছেন। রোহিঙ্গা শিবিরের অভ্যন্তরে তিন শতাধিক মাদ্রাসার মধ্যে আরসার সদস্যরা শক্তি প্রয়োগ করে ১৭০টির বেশি মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ উলামা কাউন্সিলকে নিয়ে দেয়। অবশিষ্ট মাদ্রাসাগুলো ইসলামি মাহাসের নিয়ন্ত্রণে। সেসব মাদ্রাসা দখলের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে উলামা পরিষদ। মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে মাহাস নেতাদের একাধিবার হুমকিও দেন আরসা নেতারা। শুক্রবার ভোররাতে থাইনখালীর যে মসজিদ ও মাদ্রাসায় হামলা চালানো হয়, সেটি ইসলামি মাহাস পরিচালিত। আর হামলা অংশগ্রহণকারীরা আরসা ও উলামা কাউন্সিলের নেতা–কর্মী।

রোহিঙ্গা নেতাদের ভাষ্য, উলামা কাউন্সিল পরিচালনা করেন রোহিঙ্গা নেতা হাফিজুল্লাহ। তিনি ক্যাম্পের বাইরে অবস্থান করেন। অন্যদিকে ইসলামি মাহাসের নেতৃত্বে দিচ্ছেন মৌলভি সেলিম উল্লাহ। তিনি থাকেন উখিয়ার বালুখালীর ক্যাম্প-১৩–এর সি-ব্লকে। নানাভাবে চেষ্টা করে তাঁকে পাওয়া যায়নি।

রোহিঙ্গা নেতাদের ভাষ্য, একসময় মৌলভি সেলিম উল্লাহ আরসার কমান্ডার ছিলেন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা, ক্যাম্পে চাঁদাবাজি, মাদক ও সোনা চোরাচালানে যুক্তসহ অপহরণ, ধর্ষণ, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ায় তিনি আরসা ছেড়ে ইসলামি মাহাস সংগঠন গড়ে তোলেন। এরপর থেকে আরসা সদস্যরা ইসলামি মাহাস নেতাদের পেছনে লাগেছে।

দ্বিতীয় কারণটি হলো, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যু। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে মৌলভি সেলিমসহ ইসলামি মাহাস নেতারা সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে জনমত গঠন করতেন। বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও নামাজের খুতবায় আরসার অপতৎপরতা নিয়ে রোহিঙ্গাদের সতর্ক ও সচেতন করতেন মাহাস নেতারা। এতে ক্ষিপ্ত হয় আরসা।

তৃতীয় কারণ, আরসা সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার। গত ২৯ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডেরর পর ক্যাম্পে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ পর্যন্ত ৫২টি অস্ত্রসহ ধরা পড়েছে শতাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী। এর মধ্যে অন্তত ১৫ জন আরসার সক্রিয় সদস্য বলে রোহিঙ্গা নেতারা দাবি করলেও পুলিশ বরাবরই বলে আসছে, ক্যাম্পে আরসা অথবা আল-ইয়াকিন নামে কোনো সংগঠনের অস্থিত্ব নেই। তবে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা আরসা ও আল-ইয়াকিনের নাম ব্যবহার করে অপকর্ম চালায়।

আরসা মনে করে, তাদের সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পেছনে ইসলামি মাহাসের হাত রয়েছে। মাহাসের নেতারা পুলিশকে আরসার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে গোপনে তথ্য সরবরাহ করেন। এর রেশ ধরে মাদ্রাসায় হামলার ঘটনা।

চতুর্থ কারণ অধিপত্য বিস্তার। বিদেশ থেকে ক্যাম্পের মাদ্রাসা-মসজিদের নামে পাঠানো হয় বিপুল টাকা। এ টাকার ভাগাভাগি নিয়ে দুই সংগঠনের মধ্যে বিরোধ লাগে। বেশি টাকা পায় ইসলামি মাহাস। তাদের পক্ষে কাজ করে আরও কয়েকটি রোহিঙ্গা সংগঠন। তাছাড়া ক্যাম্পের অভ্যন্তরে ইয়াবা ও সোনার ব্যবসায় ভাগ বসায় আরসা। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে তৈরি রোহিঙ্গাদের অন্তত ১৪ হাজার দোকানপাট আছে; সেখান থেকে চাঁদা তোলে আরসা। মুহিবুল্লাহ হত্যার পর আধিপত্য বিস্তার এবং তাদের শক্তি জানান দিতে খুন–খারাবির ঘটনা সংঘটিত করে আলোচনায় আসছে আরসা।

যেভাবে ঘটে সেদিনের হামলা

পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতারা জানান, ২২ অক্টোবর ভোররাত সাড়ে তিনটায় ওই ক্যাম্পের ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়া’ মাদ্রাসা ও সঙ্গে লাগোয়া মসজিদে হামলা চালায় আড়াই শতাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী। সন্ত্রাসীদের গুলি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত হন মসজিদে তাহাজ্জুতের নামাজ পড়তে যাওয়া ছয়জন রোহিঙ্গা।

নিহত রোহিঙ্গারা হলেন, ওই মাদ্রাসার শিক্ষক ও বালুখালী ২ নম্বর শিবিরের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইদ্রিস, বালুখালী-৯ নম্বর শিবিরের ব্লক-২৯-এর বাসিন্দা ইব্রাহীম হোসেন, বালুখালী ১৮ নম্বর ক্যাম্পের এইচ ব্লকের বাসিন্দা ও স্বেচ্ছাসেবক আজিজুল হক ও মোহাম্মদ আমিন, একই মাদ্রাসার শিক্ষক ও বালুখালী-১৮ নম্বর শিবিরের, ব্লক-এফ-২২-এর নুর আলম ওরফে হালিম এবং মাদ্রাসাশিক্ষক ও ২৪ নম্বর শিবিরের হামিদুল্লাহ।

হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শনিবার রাতে উখিয়া থানায় ২৫ জন রোহিঙ্গার নাম উল্লেখ করে আরও ২৫০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন গুলিতে নিহত আজিজুল হকের বাবা নুরুল ইসলাম।

মামলার সত্যতা নিশ্চিত করে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, মাদ্রাসায় হামলা চালিয়ে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারে সেখানে (ক্যাম্পে) অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র জানিয়েছে, হত্যা মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে উখিয়ার বালুখালী শিবিরের (ক্যাম্প-১৮) রোহিঙ্গা মৌলভি আকিজ ওরফে মৌলভি অলিকে। তিনি আরসার কমান্ডার হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়া আরসার সঙ্গে যুক্ত আরও ২৪ জন রোহিঙ্গাকে মামলার আসামি করা হয়েছে। আরসা নেতা মৌলভি অলির নেতৃত্বে শুক্রবার ভোররাতে ওই মসজিদের হামলা চালানো হয়েছিল বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গা মাঝিরা (নেতা)।

কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা বলেন, শুক্রবার ভোররাতে মসজিদে হামলার ঘটনায় পৃথক তিনটি দলে দুই শতাধিক আরসা সদস্য ও উলামা কাউন্সিল সদস্য অংশ নেন। এর মধ্যে ২২-২৫ জনের একটি দল নিয়ে মসজিদে ঢুকে গুলি চালান আরসা নেতা (মামলার প্রধান আসামি) ও বালুখালী-শিবিরের (ক্যাম্প-১৮) রোহিঙ্গা মৌলভি আকিজ উদ্দিন ওরফে মৌলভি অলি। মসজিদের বাইরে ও মাদ্রাসায় হামলা চালায় বালুখালী শিবিরের (ক্যাম্প-৯) সি-৬ ব্লকের রোহিঙ্গা নুরুল কলিম ওরফে ডাক্তার ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে ৮০ জনের আরেকটি দল। বাইরে কেউ এসে হামলাকারীদের প্রতিরোধ করতে যেন না পারে, সে জন্য মসজিদ-মাদ্রাসার বাইরের রাস্তায় অবস্থান নেয় বালুখালী শিবিরের (ক্যাম্প-৮ /ইস্ট) বি-৪৪ ব্লকের রোহিঙ্গা মৌলভি দিলদার হোসেন ওরফে জহির হোসেন ওরফে মৌলভি আবু বক্করের নেতৃত্বে ১৪৫ জনের বেশি আরেকটি দল। কমবেশি সবার হাতে ছিল পিস্তল, দেশীয় তৈরি ওয়ান শুটারগান, দেশীয় বন্দুক ও ধারালো অস্ত্র দা-কিরিচ ও লাঠি।

রোহিঙ্গা নেতা রহিম উল্লাহ বলেন, মাদ্রাসা ও মসজিদে হামলার ঘটনায় জড়িত কমবেশি সবাই আরসা সদস্য। মাদ্রাসাটি দখলের জন্য এটি আরসার পরিকল্পিত হামলা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন রোহিঙ্গা মাঝি বলেন, ঘটনার পরপর হামলাকারী আরসা নেতা মৌলভি অলি, নুরুল কলিম, মৌলভি দিলদার হোসেনসহ ২০-২৫ জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ক্যাম্প থেকে পালিয়ে উখিয়ার বালুখালী, রহমতেরবিল, আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত দিয়ে নাফ নদী পেরিয়ে মিয়ানমারের নোম্যান্সল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছে। সেখান থেকে ক্যম্পে যোগাযোগ রাখছে তারা। নাফ নদীর মিয়ানমার সীমান্তের ওই নোম্যান্সল্যান্ডে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যাতায়াতের সুযোগ নেই। নোম্যান্সল্যান্ডটি মিয়ানমারের কাছাকাছি এলাকায় পড়েছে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা ও নির্যাতনের মুখে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন আট লাখ রোহিঙ্গা। তার আগে আসে আরও কয়েক লাখ। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখ। শরণার্থীদের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) পৃথক তিনটি ব্যাটালিয়নের দুই হাজারের বেশি সদস্য।

রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখতে শুক্রবার থেকে কক্সবাজারে অবস্থান করছেন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) প্রধান ও ডিআইজি আজাদ মিয়া বলেন, হামলাকারীদের শনাক্ত করা হয়েছে, কয়েকজন ধরাও পড়েছে। ধরা পড়া রোহিঙ্গারা আরসা বা আল-ইয়াকিন সদস্য বলা হলেও ক্যাম্পে এ ধরনের সংগঠন নেই। (তথ্যসূত্র- প্রথম আলো)


এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ